সাম্প্রতিক নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্বের মতো পাহাড়েও প্রথমদিকে ভীষণ আতঙ্ক বিরাজ করেছিলো। করোনার সংক্রমণে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিতে পড়লেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ঝুঁকিতে পড়েনি। কিন্তু পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ায় বাড়তে পারে করোনা সংক্রমণ, বাড়তে পারে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি। পর্যটন ব্যবসায়ে জড়িত অংশ লাভবান হলেও পাহাড়ে অর্থনীতিতে এর বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন আদিবাসী বিশেষজ্ঞরা।
বলা যায়, পাহাড়িরা সম্পূর্ণ বাজার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল নয়। এরা বেশির ভাগই এখনো জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। পাহাড়িরা ব্যবসায়ের উদ্দ্যেশ্যে চাষাবাদ করে না। তবে, নিজেদের প্রয়োজনের বেশি ফসল সঞ্চয়ে থাকলে, সেই অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে আয় উপার্জন করে থাকে।
কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথমদিকে করোনা সংক্রমণের সময়ে বাজারে বিক্রি করার মতো পাহাড়িদের হাতে তখনো কোনো পণ্য ছিলো না। তবে, এপ্রিল ও মে মাসের দিকে লকডাউনে রাস্তাঘাট ও বাজার বন্ধ থাকায় বাগানচাষীদের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ফসলের নায্য মূল্য না পাওয়া, ফসল পচে যাওয়া ও বাজার সংকট ছিলো সেইসময়ের বাগানচাষীদের প্রধান সমস্যা। চলতি বছরের জুন – জুলাই এর দিকে সীমিত আকারে লকডাউন খুলে দিলে সমস্যা কিছুটা দূর হয়।
এছাড়া ফ্যাক্টরি, পার্লার, গার্মেন্টসসহ নানান বেসরকারি শাখায় যারা চাকরি করতো, করোনা তাদের একেবারেই নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলো। অন্যদিকে, শহুরে পাহাড়িরা লকডাউনে গাড়ি চলাচল না করায় বিভিন্ন শহর থেকে শতশত মাইল পথ পায়ে হেঁটে বাড়িতে এসেছে। এরমধ্যে অনেকেই চাকরি হারিয়েছে। এমনকি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাইরে কোয়ারেন্টাইনেও তাদের কষ্ট করে থাকতে হয়েছে। প্রথম দিকে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়লেও পরে তা কাটিয়ে উঠতে তাদের অনেককেই পাহাড়ে বাগান চাষ শুরু করে দিতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি তিনটা জেলা মিলে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩ টা জাতি বসবাস করছে। নিজ নিজ সংস্কৃতি নিয়ে পিছিয়ে পড়া এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, নির্যাতন, অত্যাচার ও দারিদ্রকে সঙ্গী করে অনেক বছর ধরে সংগ্রাম করে পাহাড়ে জীবন নির্বাহ করে আসছে।
করোনাকালীন সময়ে বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চল ম্রো পাড়া থেকে শুরু করে রাঙ্গামাটি সাজেকের আদিবাসীদের খাদ্যের অভাবে জংলি আলু খেয়ে থাকতেও দেখা গেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। তবে, এই খাদ্য অভাবের প্রধান কারণ করোনা নয়। কেনো না, দুর্গম পাহাড়ি এই অঞ্চলগুলোতে প্রত্যেক বছর খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। খাদ্যের অভাবে অনেক গ্রামে পাহাড়িদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মূলতঃ পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে চাষাযোগ্য ভূমি দখল করে পর্যটন নির্মাণ করা ও সারা দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কৃষিজ উৎপাদন কমে যাওয়ায় হচ্ছে এই খাদ্য সংকটের মূখ্য কারণ।
এছাড়া, প্রান্তিক অঞ্চলের পাহাড়িদের ভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ায় অনেক পাহাড়িদের দেশ ত্যাগের খবরও শোনা যায়। ওই সময়ে পাহাড়ের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে অনেক দুঃখী আদিবাসীদের হাতে পৌঁছায়নি সরকারিভাবে খাদ্য ও ত্রানের সহযোগিতা। তবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যেমনঃ উন্মেষ, জুবদা, পাহাড়ি উদ্যোক্তা হাট, কাচালং ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ, সবুজ খাম, বিএমএসসি, টিএসএফ, বনফুলের জন্য জুন্ম তারুণ্য ভালোবাসা সহ আরো নানান সংগঠন দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে ত্রানের ব্যবস্থা করেছিলো।
দীর্ঘ মাস ধরে লকডাউনে পর্যটন বন্ধ থাকায় পাহাড়ে সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনের উপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ীদের। তবে, ব্যাপারটা এমনও না যে এই ব্যবসায়ে না জড়ালে তারা না খেয়ে মরে যাবে। পর্যটন খুলে দেওয়ায় সংক্রমণের আশংকা দেখা দিচ্ছে আর শীত এলে এর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে।
এর ফলে ব্যবসায়ে জড়িত অংশ লাভবান হলেও পাহাড়ে অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে প্রশাসনের উচিত হবে সকল সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনীতি জন্য একটা টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আনন্দবাজার/ইউএসএস/অ.স.ম