ফজলে রাব্বি ফরহাদ
মাদক এক ভয়াবহ ঘাতকের নাম। যেটা নীরবে ধ্বংস করে দেয় একটি মানুষ, একটি পরিবার আর একটি জাতিকে। মাদক এর আভিধানিক অর্থ ঔষধ। যে সমস্ত প্রাকৃতিক দ্রব্য বা রাসায়নিক দ্রব্য গ্রহণ করার ফলে একজন মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে সেটাই মাদক। একটা সময় ছিলো যখন মাদক এতটা সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু বর্তমান সমাজ পুরোপুরি ভিন্ন পর্যায়ে, যেখানে হাত বাড়ালেই মিলবে বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য। খুব সহজেই প্রবেশ করা যায় মাদকের রাজ্যে। আর এই দিকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে আমাদের তরুণপ্রজন্ম। মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের যুবসমাজ।
দেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় একটি অংশ তরুণ প্রজন্ম। তরুণরা একটি দেশের ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা। তাদের মধ্যে যে শক্তি, সাহস আর উদ্দীপনা রয়েছে, সেটা যদি দেশের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় সেটা হবে একটা দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের কান্ডারী হবে। আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা এই তারুণ্যেরই জয়গান গেয়েছেন। আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার জন্য শপথ নিতে শিখতে হবে তরুণসমাজকে। পাশাপাশি দেশটাকে সুন্দর করতে স্বার্থকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মানসিকতা অন্তরে ধারণ করতে হবে। তবে কি এই মাদকের ভয়াল থাবায় বিপন্ন হবে আমাদের তরুণসমাজ? আমাদের আগামীর কর্ণধারদের সফল হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাড়াবে এই মাদক?
মাদক সেবনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় ১৫ থেকে ৩০ বছরের বয়সীদের মধ্যে। মাদকসেবীর মধ্যে ৮০ শতাংশই তরুণ আবার তন্মধ্যে ৪০ শতাংশ হলো বেকার। এই মাদকসেবীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকসেবন এখন পরিণত হয়েছে একটা মরণফাঁদে। তরুণদের পাশাপাশি আজ তরুণীরাও এই পথে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের ছোবলে এদের কোমল হাত রুপান্তরিত হচ্ছে একেকজন খুনীর হাতে। আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যান নি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া শিক্ষার্থী ঐশীর কথা! যার হাতে খুন হতে হয়েছিল তার পিতা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার মাতা স্বপ্না রহমানকে। তাদের দোষ ছিলো তারা তাদের মেয়েকে মাদকাসক্ত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। সারাদেশে আপনি খোঁজ করলে আপনি পাবেন শত ঐশীকে। যারা নিত্যদিন মাদকাসক্ত হয়ে খুন করছে মাতাপিতা কিংবা পরিবারের অন্য কোন সদস্য অথবা একটি পরিবারের সুন্দর স্বপ্নকে।
বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের তরুণদের সকল শক্তি, সাহস আর উদ্দীপনা হারিয়ে যাচ্ছে মাদকের ভয়াল গ্রাসে। দিনদিন এই মাদকের সম্প্রসারণ বেড়েই চলছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, মাদক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে? আর এর পরিণতিই বা কি হবে? কিংবা এর থেকে উত্তরণের উপায় বা কি?
এই মাদকের রাজ্যে প্রবেশ করার প্রথম সদর দরজা হলো ধূমপান বা তামাক গ্রহণ। যেটা আজ শহরাঞ্চল কিংবা গ্রামাঞ্চল সবজায়গায় বিদ্যমান। এমনকি আমাদের আগামীর স্বপ্ন যারা, সেই শিক্ষার্থীদের অনেকেই এটাকে মনে করে স্মার্ট হওয়ার মানদণ্ড। সুতরাং আর বুঝতে বাকী নেই, মাদক এই জাতিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে দাড় করিয়েছে।
মাদকাসক্তির পিছনে কাজ করে তিনটি কারণ। জৈবিক, ব্যক্তিভিত্তিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা। এক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থাই মূখ্য ভূমিকা পালন করে। বন্ধু-বান্ধবের খারাপ প্রভাব, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহণের ইচ্ছা, অবসর সময় কাটানোর কোন ভালো মাধ্যম না থাকা, হতাশা ও ক্ষোভ, মূল্যবোধের অভাব, মাদকের ভয়াবহতা না জানা, মাদকের সহজলভ্যতা, খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহজেই আনন্দ পাওয়ার ও যৌনশক্তি বৃদ্ধির ইচ্ছা। পারিবারিক কলহও মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ।
মাদকাসক্তির ফলে আমাদের শারীরিক, সামাজিক, মানসিক, আর্থিক ও আধ্যাত্নিক ক্ষতিসাধন হয়। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো ও দূর্বল হয়ে পড়ে। মাদক এমন একটি জিনিস যেটা একজন মানুষকে জীবনকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরিয়ে নেয়।
মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব কিছু নয়। সেজন্য, আমাদের তরুণসমাজকে এই ভয়াবহ অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য পরিবার ও সচেতন সমাজকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিভিন্ন আঙ্গিকে তরুণসমাজকে এই অভিশাপের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদেরকে এই অন্ধকার থেকে বের করে আলোর পথ দেখাতে হবে। পরিবারগুলো সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে, তাদেরকে সুস্থ বিনোদনে উৎসাহিত করতে হবে আর অবশ্যই পারিবারিক কলহ-বিবাদ বর্জন করতে হবে। সন্তানদের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অবসর সময়ে তাদেরকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া ও প্রাণভরে মায়া মাখা কণ্ঠে কথা বলাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যদি আমরা অতি শীঘ্রই এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে না পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎের জন্য আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি না। তাই, খুব দ্রুতই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বয় করে কাজ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের তরুণদেরকে বাঁচাতে হবে। যাতে আমরা আমাদের স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারি।
লেখক: ফজলে রাব্বি ফরহাদ
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আনন্দবাজার/শাহী/রাব্বি