ঢাকা | শনিবার
২৮শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লবণাক্ত পানির ব্যবহারে জরায়ু হারাচ্ছেন উপকূলের নারীরা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। সেই সাথে মাত্রাতিরিক্ত এসব লোনা পানি প্রতিদিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার নারীরা। ফলে অল্প বয়সেই জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন এই এলাকার বেশিরভাগ নারীই।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ৯ নম্বর সোরা গ্রামের আসমা বেগম (৩০)। বিগত সাত বছর আগে মাত্র ২৩ বছর বয়সে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে ফেলেন তিনি। আসমা জানান, ছোট থেকেই আমার ধাতুর (সাদাস্রাব) অনেক সমস্যা ছিল। বিয়ের পরে প্রথম সন্তান জন্মের পর থেকেই জরায়ুতে জ্বালা-পোড়া এবং যন্ত্রণা হতো। একে একে তিন সন্তান জন্মের পর জানলাম জরায়ুতে ঘা হয়েছে। তখন অবস্থা খুব খারাপ ছিল। পরে খুলনার এক হাসপাতালে ভর্তি হলে অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলে দেন ডাক্তার।

আসমার মত আরও অনেক নারী লোনা পানি ব্যবহারে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু গাবুরা নয়, উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের প্রায় সব গ্রামেই জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নারীদের জরায়ু সংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লোনাপানিপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি।

শ্যামনগরের তিনটি বেসরকারি ক্লিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বছরে মোট অপারেশনের প্রায় ১০ শতাংশ রোগীর জরায়ু অপারেশন হয়ে থাকে। এসব ক্লিনিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জরায়ু কেটে ফেলার হার বেশি।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে জরায়ু সমস্যায় ভুগতে থাকলে তা ক্যান্সারে পরিণত হয়।  জানা গেছে, শ্যামনগরে অবস্থিত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জরায়ুর অসুখের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে ৩৮০ জন নারীর ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এদের মধ্যে ২৩ জনের ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি আছে। তাই পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাদের দুইজনকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাকিদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।

এই ব্যাপারে শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তাসনুভা আফরিন জানান, হাসপাতালে আমি মাসে গড়ে প্রায় নয়শ’ রোগী দেখি। কিন্তু এদের মধ্যে ১০-১২ জন রোগী পাই যাদের জরায়ু কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া জরায়ু সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি।

তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে জরায়ু কেটে ফেলাটাকেই তারা একমাত্র সমাধান মনে করছেন। কিন্তু এর ফলে তাদের শারীরিক সমস্যা ব্যাপক হারে যাচ্ছে। এতে অনেকের সংসারই ভেঙে যায়। সাধারণ মাত্রার লবণ পানি অনেক সময় অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ভালো কাজ করে। কিন্তু অতিতিরিক্ত লবণাক্ত এবং অপরিচ্ছন্ন চর্মরোগ, জরায়ু সংক্রান্ত নানা রোগের কারণ হয়ে ওঠে।

ডা. তাসনুভা অবশ্য মনে করেন, জরায়ু সংক্রান্ত রোগের সঠিকভাবে চিকিৎসা প্রয়োজন। এ এলাকার নারীরা সঠিক গাইডলাইন না পাওয়ার কারণেই জরায়ু কেটে ফেলে দিতে বাধ্য হন।এছাড়াও লিউকোরিয়ায় ভুগছে শিশু থেকে নারী। এমনকি ঘরে ঘরে চর্মরোগসহ নানা অসুখ-বিসুখ দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ জানান, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর–কালিগঞ্জে ২০০-২৫০ ফুট গভীর পানির স্তর থাকলেও তা প্রচণ্ড লোনা। এরপর আবার ১১০০ ফুট পর্যন্ত কোনো পানির স্তর নেই। তবে গাবুরাতে ৬০০-৭০০ ফুট পর্যন্ত গিয়ে কিছুটা খাবারযোগ্য পানি পাওয়া যায়। কিন্তু সাধারণ কোনো পরিবারের পক্ষে এত গভীর টিউবওয়েল বসানো সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।

আনন্দবাজার/এইচ এস কে

সংবাদটি শেয়ার করুন