ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে

বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের এবং নিজের পরিবারের সকলের দুই বেলার দু’মুঠো আহার যোগাতে সকাল শুরু হতে না হতেই শুরু হয় মানুষের কর্মব্যস্ততা।আর এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেই ঘটে যায় নানা রকম অঘটন।যার মধ্যে অন্যতম সড়ক দুর্ঘটনা। নিরাপদ জীবনেযাপনের ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা সার্বক্ষণিক একটি হুমকি স্বরুপ কাজ হিসাবে করে সাধারণ মানুষদের।বর্তমানে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। যার ফলে নির্বিবাদে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু তার পরেও নেই সঠিক ব্যাবস্থাপনা বা জনসচেতনতা।কালে কালে বাংলাদেশের সড়ক ব্যাবস্থার উন্নতি হলেও দিনদিন সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়েই চলেছে দ্রুত গতিতে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে রাস্তায় চলাচলকারী ব্যাক্তিদের।প্রত্যেকটা সময় থাকতে হয় আতংকে এই বুঝি গাড়ি উঠে গেলো গায়ের উপর!এই বুঝি আর বাড়ি ফেরা হলো না!

আমরা একটু লক্ষ্যো করলেই দেখতে পাই যে প্রতিনিয়তই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অতি দ্রুত গতিতে বেড়েই চলেছে।সাম্প্রতি ঘটে যাওয়া দেশের কয়েকটা সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরছি-

(১)কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী শাহজাহান ও তার তার শ্যালিকা নাজমা বেগমের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।(৬ আগস্ট) দুপুরে উপজেলার আন্ধারীঝাড় বাজারের কাছে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কের আয়নালের চাতালের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
(২)(২রা আগস্ট)নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে নৈশ কোচের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহী একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হয়েছে।
(৩)লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ঈদের দাওয়াত খেতে মামার বাড়িতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলের ধাক্কায়(১ আগস্ট)এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
(৪)গোপালগঞ্জে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনায় সিঙ্গাপুর প্রবাসীসহ তার পরিবারের ৩ সদস্য নিহত হয়েছেন। (৩০ জুলা্ই) ভোর ৪ টার দিকে কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ফ্লাইওভারে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
(৫)মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দী নিশিপুর গো-হাটের পাশে এটিএন নিউজের এক কর্মকর্তাসহ ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুইজন নিহত হয়েছেন।(২ আগস্ট) সকাল এগারটার দিকে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে বলেছেন এ বছরের গত জুলাই মাসেই ২৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় দেশব্যাপী ৩৫৬ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ৩৪১ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ৬৪ জন এবং শিশু ৩৫ জন।এছাড়া,রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে বলছে, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বেশির ভাগই ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এখানে ৭০টি দুর্ঘটনায় ৭৬ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে। এ অঞ্চলে ২৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭ জন। একক জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ময়মনসিংহে। এখানে ১৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেব ১৯ জন। একক জেলা হিসেবে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার।এবং গত জানুয়ারী মাসে সারাদেশে ৩৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৪৪৫ জন নিহত ও ৮৩৪ জন আহত হয়েছেন।

প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে তরতাজা প্রাণ। মুহূর্তের মধ্যে খালি করে দিচ্ছে কোন এক মায়ের কোল।অনেকেই আবার বেঁচে থাকছে পঙ্গু হয়ে।ভুগতে হচ্ছে সারাজীবন। তাই তো বলে“একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না।”ঠিক যেনো তাই।কেউ যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তাহলে সে মারা যাবার পর তাকে হারিয়ে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার পরিবারের।আর যদি সে আহত অবস্থায় থাকে তাহলেও সবাইকে ভুগতে হয়।আর এই সড়ক দুর্ঘটনার পিছনে নেই কোন একক কারণ। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এই সড়ক দুর্ঘটনার পিছে আছে নানাবিধ কারণ যেমনঃ

(১)অতিরিক্ত গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।গন্তব্য স্থানে দ্রুত পৌছানোর জন্য গাড়ির চাকল গতি বাড়িয়ে দেয়।ফলে সামনে থাকা অন্য গাড়িকে অতিক্রম করতে গিয়ে অনেক সময় ধাক্কা লেগে যায়।এমনকি গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে পথচারীদের চাপাও দিয়ে দেয় কিছু উগ্রপন্থি বা টালমাটাল চাকল গুলো। সড়কে কিছু ড্রাইভার আছেন যারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়।পুলিশের বেশির ভাগ রিপোর্টে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসাবে দেখা যায় গাড়ির অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মনোভাব।

(২)সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হচ্ছে অনুন্নত সড়কব্যবস্থা।বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমান উন্নত না।এছাড়া আমাদের দেশের যানবাহনের তুলনায় রাস্তা গুলো পর্যাপ্ত না। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চল এবং ঢাকা-চট্রগ্রামের মহাসড়কগুলো ব্যস্ততম সড়ক।ফলে এসব ব্যস্ততম সড়কে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনা। তবে সরকার এই সড়কগুলো চার লেন করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে,তা সম্পন্ন হলে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।

(৩)বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অদক্ষ চালক।আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকেরই নেই যথাযথ প্রশিক্ষণ। এদের মধ্যে আবার অনেকেরই নেই লাইসেন্স। আবার অনেকে হেল্পার থেকে ড্রাইভার হয়ে থাকে।অনেক চালক আছে যারা একেবারেই অদক্ষ এবং ট্রাফিক আইননের বিষয়ে পুরাই অজ্ঞ।যেকারণে গাড়ি চাককের সময় তারা মোবাইল ফোনে কথা বলে আবার ফুল ভলিউম দিয়ে গান শোনার কারণে আসেপাশের ঘটনা বা কোন গাড়ির সংকেত বা হর্ন তারা শুনতে পায় না।আবার লক্ষ্য করলেই দেখা যায় অনেক চাললের গাড়ি চালানোর পর্যাপ্ত বয়স হয় নি বা শারিরীক-মানুষিক সক্ষমতা ছাড়াই চালকরা গাড়ি চালিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে অকালে ঝরিয়ে দেয় তাজা প্রাণ।

(৪)ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ।আমাদের রাস্তাঘাটের দিকে তাকালে বোঝা যায় বহুদিনের পুরানো যানবাহনের সংখ্যায় বেশি।সব থেকে বড় কথা হচ্ছে এদের অধিকাংশদের ফিটনেস সার্টিফিকেটও নেই।প্রশাসন এদেরকে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করার পরেও এই যানবাহন গুলো সড়কে চলাচল করছে এবং বড় বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।

(৫)অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরেকটা কারণ। বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়েই চলেছে। আর জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে যানবাহনও।জনসংখ্যা বাড়ছে, যানবাহন আছে কিন্তু বাড়ছে না সেই তুলনায় সড়কের প্রশস্ততা বা বিকল্প কোন উপায়।যে কারণে দীর্ঘ সময় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।আর ব্যস্ততার কারণে চালকরা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে।

কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার পিছনে শুধু যে চালকরাই দায়ী বা সব সময় যে চালকদেরই দোষ তা কিন্তু না।চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার পিছে আছে যাত্রী বা পথচারীদের অসাবধানতা বা অজ্ঞতা। যেকারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে দ্রুত গতিতে। মাঝে মাঝে দেখা যায় পথচারীরা ট্রাফিক আইন বা জেব্রা ক্রসিং না মেনেই এলোমেলো ভাবে চলাচল করে আবার কখনও বাস বা ট্রাকের ছাদে উঠে অস্বাভাবিক আচারণে লিপ্ত হয় যার ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।যাত্রীদের বা পথচারীদের এমন বেপরোয়া আচারণ প্রতিহত করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।তাহলেই তাদের এমন আচারণের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাবে শুধু তাজা প্রাণ নষ্ট হয় না বরং শারীরিক,মানুষিক,অর্থনৈতিক,সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়।দুর্ঘটনা যেভাবেই হোক না কেনো তার ফলাফল সব সময় ভয়ংকর। মানব সম্পদের বিনাশ এই সড়ক দুর্ঘটনার সব চেয়ে বড় ক্ষতি।দুর্ঘটনায় কবলিত একটা পরিবার দীর্ঘদিন ধরে হাহাকার করে থাকেন।তাদের এই ক্ষতি অপূরনীয়। কোন ভাবেই তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না।আর যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি এরুপ দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে থাকে তাহলে তাহলে তার প্রভাব পড়ে দীর্ঘদিন ধরে।

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে একটা প্রকট আকার ধারণ করেছে।তবে সড়ক দুর্ঘটনা কোন বিশাল সমস্যা না যদি আমরা প্রত্যেকে প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি মেনে চলি।সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে প্রত্যেকের অধিক সচেতনতা বা সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যেমনঃ
চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রকৃত লাইসেন্স ধারীরায় গাড়ি চালায় কিনা যাচাই করে দেখা।চলন্ত অবস্থায় চালকদের সাথে কথা না বলা।এবং অভারটেকিং প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকা।অতি পুরানো গাড়ি চলাচলে নিষিদ্ধ করা।অতি ব্যাস্ততম জায়গা গুলোতে ফুট অভার ব্রিজ বা নিরাপত্তা জোরদার করা।ট্রাফিক বা সড়ক নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সকলকে অবগত রাখা।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ যত জটিলই হোক না কেনো সরকারের পাশাপাশি আমরা সকলে এর সমাধানে এগিয়ে এলে দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব। এজন্য সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করে চলাচল করতে হবে।এবং যথাযথ নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে সকলকেই একটা কথা মনে রাখতে হবে “একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না”সেজন্য শুধু মাত্র কোন একক সমাজ বা গুষ্টিকে সচেতন হলেই হবে না সচেতন ও সতর্ক হতে হবে সবাইকে। তবেই সড়ক হবে নিরাপদ ও আনন্দদায়ক।

লেখকঃইমরান হুসাইন।
শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আনন্দবাজার/শাহী

সংবাদটি শেয়ার করুন