ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ত্যাগের মহিমায় ঈদ

রাকিব দেওয়ান

পৃথিবীর প্রতিটি জাতির নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। প্রতিটি জাতিই তাদের ধর্মীয় উৎসব গুলো বিশেষ গুরুত্বের সাথে উদযাপন করে থাকে। ঈদ উৎসব মুসলমানদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। প্রতিটি ঈদ মুসলমানদের ঘরে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। ধনী-গরিব সকলের জন্যই এই ঈদ উৎসব।

ঈদ আরবি শব্দ যার অর্থ খুশি বা উৎসব। প্রতিবছর দুটি ঈদ অনুষ্ঠিত হয় ১. ঈদুল ফিতর, ২. ঈদুল আযহা।

ত্যাগের মহিমা কে সামনে রেখে আমাদের মাঝে এসেছে ঈদুল আযহা, কিন্তু এ কেমন ঈদের আগমন! এক্ষেত্রে ভিন্নতা সবার চোখে পড়ার মতো। মুসলিম বিশ্বে একমাস সিয়াম সাধনার পরে আসে ঈদ, এরপর দীর্ঘ আড়াই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আসে কুরবানির ঈদ। সুশৃঙ্খল আচার আচরণের তীর ঘেঁষে আসে ঈদ। আসে আত্মশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে। সামষ্টিক কল্যাণ সচেতনতার মোহনা অতিক্রম করে ঈদ আসে।

ব্যক্তি উর্ধ্বে যে সমাজ, এমন কী সমাজের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে যে বিশ্ব মানব সমাজ বা উম্মাহ তার সুখ দুখের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে ঈদ আসে। তাই ঈদের আনন্দে নেই ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস। নেই বাঁধন ছাড়া গতি। নেই অসংলগ্ন কোনো ছন্দ।

তাই ঈদ একদিকে যেমন আনন্দঘন উৎসব, অন্যদিকে তেমনি সকলকে সাথে নিয়ে আনন্দমুখর অনুষ্ঠানও, উৎসবে দুঃখ থাকে না, থাকে না কর্তব্যের মৃদুভাবও, অনুষ্ঠানে দুই থাকে ঈদের খুশিকে এ আলোকেই দেখা যায়। দেখা হয় ব্যক্তির সন্তুষ্টির মুহূর্তরূপে, দেখা হয় পরম করুণাময়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরা ব্যক্তি সমষ্টির সন্তুষ্টিরূপে। এ কারণে ঈদের খুশির আবেদন এত গভীর।

বাংলাদেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির নিকট ঈদুল ফিতর যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি উৎসবমুখর কুরবানিও। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার অনুষ্ঠান এটি। ধনী দরিদ্র সবার জন্য আনন্দময় দিনটি। পল্লী-শহরাঞ্চল উভয়ই উদ্বেল হয়ে ওঠে এ দিনে। এ দিনে সবাই আপন জনের সান্নিধ্য পেতে চায়। দু’দণ্ড কাটাতে চায় প্রিয়জনদের পাশে। মা পেতে চায় সন্তানকে কাছাকাছি, কুরবানির শেষে গোস্ত রুটি পরিবেশন করতে চায় সবার অংশগ্রহণে।

এজন্যই সুদূর থেকে ছুটে আসে সবাই আপন নীড়ে। কুরবানির ভাগাভাগি করে এই দিনের খুশিতে সবাই মেতে ওঠে। ঈদের জামায়াতে ছোট বড়ো সবাই হাত ধরাধরি করে শরিক হয়। ঈদের নামাজ শেষ করে উষ্ণ কোলাকুলিতে প্রাণের আবেগ বিলিয়ে দেয় সবাই।

মুরুব্বিদের সালাম জানিয়ে আনত দৃষ্টিতে তাদের স্নেহ ভালোবাসায় ভাগ বসায়। মুরুব্বিরাও আপনজনদের বুকে জড়িয়ে অনুভব করেন এক ধরণের বেহেশতি সুখ। সমগ্র সমাজব্যাপী ঈদের দিনের আনন্দ গড়িয়ে পড়ে স্নেহ-প্রীতির অঝোর ধারায়। এজন্যেই ঈদ এত প্রত্যাশিত অনুষ্ঠান। এত কাঙ্ক্ষিত উৎসব।

বাংলাদেশে ঈদের চাঁদ প্রায় সব সময় মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো। চাঁদ ওঠে, তবে ম্লান হয়ে ওঠে। এবারে চাঁদ উঠেছে, কিন্তু নেই তার মনোলোভা প্রভা। নেই তার কাঙ্ক্ষিত ঔজ্জ্বল্য। নেই সেই মন কেড়ে নেয়া দ্যুতি। ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যতিক্রম করয়েছে বটে, কিন্তু সমষ্টির দৃষ্টিতে ঈদ বিষাদের ছায়ায় মলিন।

এ সমাজে কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা সীমাহীন বিলাসী জীবনের উপযোগী ঐশ্বর্যের চোখ ধাঁধানো সৌধে বাস করেন। উপভোগ করেন পাশ্চাত্যের সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালীদের বিলাসী জীবন। প্রতিদিন তাদের উৎসবের দিন। প্রতিদিনই তাদের ঈদের দিন। তারা কিন্তু ব্যতিক্রম মাত্র। এ সমাজে বৃহৎ এক অংশ দারিদ্র‍্যক্লিষ্ট, জীবনযুদ্ধে পরাজিত, হতাশাগ্রস্ত, বঞ্চিত, অবহেলিত। তারা সাধারণ মানুষ। তারাই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার শিকার।
শিকার তারা মঙ্গারও।

তাদের সহ্য করতে হয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হ্রাসের ধকল। সহ্য করতে হয় মুদ্রাস্ফীতির বিভীষিকা। তারাই বেকারত্ব এবং আধা-বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত। কর্ম সংস্থানের অপর্যাপ্ততা তাদের জীবনেই টেনে আনে অন্ধকার রাত্রির অনিশ্চয়তা।

তারপরেও ঈদের দিনটিতে তারা আশায় বুক বাঁধেন। আহ্বমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী ছোট্ট ঘরটিতে তারা নামিয়ে আনতে চায় বেহেশতি এক পরিবেশ। নিজের নিজের সামর্থ অনুযায়ী সবাই দেখতে চায় প্রিয়জনদের মুখে একদিনের জন্যে হলেও এক টুকরো হাসি। ভুলতে চায় প্রতিদিনের জীবন যন্ত্রণা। নিজেদের সাধ্য মতো সাজাতে চায় নিজেদের সংসারটাকে।

মা-বাবার জন্যে ছোট্ট একটা উপহার, সন্তান-সন্ততিদের জন্যে নতু জামা-কাপড়, প্রিয়জনদের জন্যে সামান্য কিছু উপহার সবাই এদিন সংগ্রহ করতে চায়। প্রত্যেক এদিজ ভালো খেতে চায়। চায় পরিবার-পরিজনদের ভালো কিছু খাওয়াতে। কিন্তু তপ্ত বাজারের উত্তাপে তাদের সব আশা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কর্পূরের মতো এক লহমায় উবে যায়।

তারপরেও ঈদ এল। ঈদ এল এ নির্মম সমাজে, অবিন্যস্ত ব্যবস্থাপনার ভাঙা ঘরে, সব কিছুকে ছাপিয়ে, তারপরেও বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঈদ এল। ঈদ এল ঈদের দিনের সহাস্য সম্ভাষণ এবং উষ্ণ কোলাকুলি ডালা সাজিয়ে। পিতার হাতে কোমল ছোট্ট আঙ্গুলগুলো গলিয়ে ছোট্ট শিশুটিরও ঈদের জামায়াতে যোগদানের দাওয়াত নিয়ে এল ঈদ। বাবা-মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রবাসী সন্তানের সালাম করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এল ঈদ। প্রিয়জনের কলকোলাহলে ছোট্ট ঘরটি মুখরিত করার অঙ্গীকার নিয়ে ঈদ এল।

আমার প্রত্যাশা, সবার মুখে অন্তত এ দিনটিতে হাসি ফুটুক। এ দিনটিতে সবাই যেন জীবন-যন্ত্রণা ভুলে বুকে বুক মিলাক। আনন্দ বন্যায় ভেসে যাক সব দৈন্য-দুঃখের আবর্জনা। স্বজন-প্রিয়জন-পরিজনের কলকাকলিতে ভরে উঠুক সকল ঘর সংসার। আমার কামনা, সবার ঘরে ঈদ আসুক। আসুক বিনম্র পদভারে। আসুক অনাবিল খুশির ডালা সাজিয়ে, সবার ঘরে ঘরে।

লেখক: রাকিব দেওয়ান
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন