ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশুদের মোবাইল আসক্তি মানসিক বিকাশের বাধা

খালিদ আহম্মেদ রাজা

কুড়িগ্রামের রফিক, তার পাঁচ বছরের শিশুকন্যা জেরিন। এখন হাই পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করে। চশমা ছাড়া পড়তে সমস্যা হয়, টিভি দেখতেও সমস্যা হয়। একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ সারাক্ষণ জেরিনকে চশমা পড়ার উপদেশ দিয়ে সতর্ক করেছেন, নিয়মিত চশমা ব্যবহার না করলে তার চোখের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।

জেররিন এর মা ঝর্না বেগম বলেন, ‘দুই-আড়াই বছর বয়স থেকেই জেরিন মোবাইল ফোনে গেম খেলে। গত কয়েকদিন আগে সে আমাকে জানায়, সে ঠিকমতো টিভি দেখতে পারে না, অস্পষ্ট দেখে। সেই সময় ওর চোখের নিচে কালো দাগও আমরা লক্ষ্য করি।’

আপনি হয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আপনার পাশে বসে ছোট বাচ্চাটা খুব দুষ্টুমি করছে। বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব ধরিয়ে দিলেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও ছেড়ে দিয়ে তাকে নিমিষেই শান্ত করে আপনি আপনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। আপনার-আমার সবার বাসাতেই এই চিত্র এখন নিত্যদিনের। স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুদেরকে শান্ত রাখা, খাওয়ানো, এমনকি বর্ণমালা ও ছড়া শেখানোর কাজটিও বাবা-মায়ের জন্য অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। বিপরীতে স্মার্টফোনের উপর নির্ভরতা বাড়ছে শিশুদের। আর এই নির্ভরশীলতাই হয়ত আমাদের অজান্তে শিশুদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। অথচ আমরা কি তা নিয়ে ভাবছি?

নতুন যে কোন কিছুই শিশুদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়। আর তা যদি হয় ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন যার মধ্যে একইসাথে গান, গেমস, কার্টুন, ফানি ভিডিও সহ শিশুদের পছন্দনীয় প্রায় সব কিছুই আছে, তাহলে তো কথাই নেই। নগরায়ন ও শিল্পায়নের এই যুগে এসে আমরা সবাই ব্যবস্ত হয়ে পড়ছি। অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মা’ই শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। নিজেদের অনুপস্থিতির সময়টাতে শিশুকে শান্ত রাখতে তাই অনেকেই মোবাইল ফোনের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

কিন্তু ডাক্তারি গবেষণা মতে, স্মার্টফোনের অতি ব্যবহারে শিশুর মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর চিন্তা ও কল্পণাশক্তি ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের রঙিন পর্দার গণ্ডিতে আটকা পড়ে যায়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তির মতই শিশুরা আক্রান্ত হয়ে পড়ে “স্মার্টফোন আসক্তি”-তে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দেয় বিভিন্ন ধরণের মানসিক বৈকল্য। এমনকি চিকিৎসকরা এও জানাচ্ছেন যে, স্মার্টফোন আসক্তির কারণে শিশুর শুধুমাত্র মানসিক বিকাশই যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, বরং তারা শারীরিকভাবেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।

এই বিষয়ে জানতে গেলে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ মোখতার আলী “শিশু কিশোর” নিউজকে বলেন, ‘আজকের শিশুরা রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ঘেরা এক পরিবেশের মধ্যে বড় হচ্ছে। ফোন থেকে যে রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি নির্গত হয়, তা তাদের জন্য ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। যেসব শিশুরা ফোন ব্যবহার করে তারা অপেক্ষাকৃত অনিদ্রা এবং অস্থিরতায় ভুগে থাকে।

আপনার শিশুর স্মার্টফোনের ব্যবহার আসক্তির কুফল:
স্মার্টফোন তথা ইন্টারনেট আসক্তি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। শিশুর ধৈর্য্য ও মনোযোগ কমিয়ে দেয়। ফলে শিশু ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু, অসামাজিক ও উচ্ছৃংখল হয়ে পড়ে। তার সহজাত সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
অনেক সময় ধরে ফোন ব্যবহারের কারণে শিশুরা পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হয়। এতে তারা “মনোযোগের ঘাটতিজনিত চঞ্চলতা” বা “অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার আ্যক্টিভিটি ডিসর্ডার” নামক জটিলতায় ভোগে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে শিশুরা অপ্রাপ্ত বয়সেই না বুঝে বিভিন্ন অনৈতিক ও আপত্তিকর বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হয়। সহজেই এই্ বিষয়গুলোর মুখোমুখি হওয়াতে তারা এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছে। এ কারণে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আসক্ত শিশু ও তরুণদের মাঝে নৈতিকতার অভাব ও মূল্যবোধের অবক্ষয় অপেক্ষাকৃতভাবে প্রবল বলে গবেষকদের ধারণা।‌ অতিরিক্ত সময় ধরে ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে শিশুদের বিভিন্ন ধরণের চোখের সমস্যা দেখা দেয়। শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই শুয়ে বা বসে ফোন ব্যবহার করে। আর স্মার্টফোন আসক্ত শিশুরা ঘরের বাইরে খেলাধুলাতেও আগ্রহী হয় না। ফলে শৈশবকালীন অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির হার তাদের মাঝে খুবই বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, পরবর্তীতে এসব শিশুর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিলতা যেমন: হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

প্রতিকারের উপায় সমুহ:
আপনি আপনার শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিন। শিশুকে খেলাধুলা ও বিভিন্ন সামাজিক কাজে উৎসাহিত করুন। প্রয়োজন ছাড়া শিশুর কাছে ফোন না রাখার চেষ্টা করুন। আপনার শিশু কোন কোন ওয়েবসাইট পরিদর্শন করছে তা খেয়াল রাখুন। বিভিন্ন ফিল্টারিং সফটওয়্যার ব্যবহার করুন। ক্ষতিকর ও আপত্তিজনক ওয়েবসাইট ফায়ারওয়াল প্রোটেকশন দিয়ে বন্ধ রাখুন সন্তানকে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চায় উদ্বুদ্ধ করুন এবং ইন্টারনেট এর খারাপ দিক সম্পর্কে সচেতন করুন। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

লেখক: খালিদ আহম্মেদ রাজা
ইউনিসেফ প্রতিনধি

সংবাদটি শেয়ার করুন