শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলার মার্কস ‘লালন শাহ’

লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০) সম্পর্কে গত পাঁচ দশকে দুই বাংলায় যতরকম বই, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, মতবিরোধ, তর্ক বিতর্ক, আলাপ আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করলে বেশীরভাগ সময় লালনের ধর্ম, লালনের জন্মস্থান, লালন হিন্দু ধর্মের নাকি ইসলাম ধর্মের, লালনের ধর্মগ্রহণ, ধর্ম ত্যাগ, লালনের ছেঁউড়িয়া আখড়া, লালনের পরিবার পরিজন, লালনের বিবাহ, লালনের শিষ্য, লালনের পোশাক পরিচ্ছেদ, লালনের চুল দাঁড়ি ইত্যাদির খোঁজ খবর পাওয়া যাবে।

কিন্তু পাওয়া যাবে না লালনের ভাষাগত জ্ঞান, গানের গভীরতা,জানা যাবে না লালনের জীবন-জিজ্ঞাসার প্রতি অদম্য স্পৃহা, জানা যাবে না কেনো লালন প্রশ্ন করতেন এবং প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখতেন?জানা যাবে না লালনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিটা আসলে কি?

যেকোনো বড় মানুষ এবং তাঁর চরিত্র নিয়ে আলোচনা করলে প্রথমত দেখতে হবে সেই বড় চরিত্রটি কোন সময়ে, কোন সমাজে, কোন রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন। লালনকে বিচার করতে গেলে সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, বর্ণ, জাতিভেদ, লোকায়ত ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কার, সংস্কৃতি, জনবিন্যাস, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ, সাংস্কৃতিক ভাষা, আরবি-ফারসি ভাষা, বাঙ্গালী জাতিগত সমস্যা, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-তোষণ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্যের পশ্চাৎপদতা, সচেতন মানুষ, আধুনিক মানুষ, গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাব, অভিযোগ, দারিদ্র, দুঃখ, দুর্দশা, অসাম্য, বৈষম্য,স্পর্শ- অস্পৃশ্যের সমস্যা, পুঁথিগত বিদ্যা, জনগণের ভাষা এবং দাপ্তরিক ভাষার গরমিল, তুক তাক, তন্ত্র মন্ত্র, সিসিমফাক, টুপি দাঁড়ি, ওঝা, দরবেশ, পানি পড়া, ঝাড়ফুক, বর্ণ হিন্দুর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রের ভেদাভেদ, খোদ মুসলমানদের আশরাফ, আতরাফ, শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানী সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভক্তি, নিন্মবিত্ত কৃষক, তাঁতি, মাঝি মাল্লা, জেলে, দিনমজুর ক্ষেতমজুর, মধ্যবিত্ত মহাজন, পায়েক পেয়াদা,পুরোহিত, ধর্মব্যবসায়ী,জাতি উপজাতি, স্বজাতি স্বগোত্র ইত্যাদি জৈবিক মানসিক, বৈষয়িক, সাংস্কৃতিক বৈষম্য,অসাম্য ও জটিলতাকে আমলে নিতে হবে।এইসমস্ত সমকালীন জটিল জটিল বিষয় পরিস্থিতি বাস্তব অবস্থা আমলে না নিয়ে লালনকে আলোচনা করলে লালনের গান, লালনের জীবন, লালনের জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা, লালনের প্রশ্ন করার ধরণ ধারণ, বৈশিষ্ট্য, লালনের দর্শন,লালনের চিন্তা করার ক্ষমতা, লালনের সীমাবদ্ধতা, চিন্তার পদ্ধতি এবং উপাদান খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কেননা যেকোনো মানুষের চিন্তা কাঠামো গড়ে উঠে তাঁর চারপাশের অবস্থিত বাস্তব অবস্থা থেকে। চারপাশের পরিবেশই একটা মানুষের চিন্তা জগতে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে এবং সেই পরিস্থিতিকে পাল্টানোর জন্যও সংগ্রামের পথ তৈরী করে।

মহামতি কার্ল মার্কস বলেছেন,”মানুষের মনে বাস্তব জগতের যে প্রতিফলন ঘটে, চিন্তা আকারে তার প্রকাশই হচ্ছে ভাব।” মহামতি কমরেড লেনিনের মতে,”The reflection of nature in man’s thought must be understood not lifelessly, not abstractly, not devoid of movement not without contradiction but in the…. process of movement, the arising of contradiction and their solution.” Philosophy note book(195p)

অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্কে বাস্তুজগতের সাথে প্রতিনিয়ত ঘাতপ্রতিঘাত বা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াতেই ভাবের জন্ম হয়। চিন্তার উপাদান তৈরি হয়।

মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সব ধরণের জীব জন্তুর মধ্যেই প্রথম সংকেততন্ত্র কাজ করে যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ফার্স্ট সিঙ্গেল সিস্টেম।

কোন সময়ে সেনসেশন টা কেমন হবে? কী রকম হবে? কিভাবে কাজ করবে? বা মোড় অ্যাকশন টা কী করবে? সেটা এই ফার্স্ট সিঙ্গেল সিস্টেম দ্বারা নির্ধারিত।
আর মানুষের এই ফার্স্ট সিঙ্গেল সিস্টেম এর বাহিরেও আরেকটা সেকেন্ড সিঙ্গেল সিস্টেম রয়েছে। যা জীবজন্তুর মধ্যে নেই।

যেটাকে বলে সেনসেশন টু পারসেপশন এবং পারসেপশন টু ট্রান্সলেশন অর্থাৎ প্রথম সংকেতন্ত্রের ক্রিয়ায় যে ভাব আসলো তাতেই চিন্তায় বা ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
ভাবছে, বিশ্লেষণ করছে এবং তা ভাষায় প্রকাশ করছে। যখনি মানুষের মধ্যে পেরসেপশন টা এসেছে বা ধারণা টা জন্ম হয়েছে তখনি উপলব্ধি জিনিসটা পরিষ্কারভাবে সামনে আসে এবং তা আমরা ভাষায় প্রকাশ করি। যাকে আমরা বলি ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা। এই জায়গায় মূল কথাটা হলো মানুষ এবং জীবজন্তু যেকোনো প্রতিকূল অবস্থায় ব্যথা পাচ্ছে বা কষ্ট পাচ্ছে, রোদে শুকাচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজছে কিন্তু তার হাত থেকে কিভাবে রেহাই পাওয়া যায়? তাকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? জীবজন্তু এই ধারণাটা জন্ম দিতে পারে না।

আর মানুষ কষ্ট পাচ্ছে বলেই সুখ সৃষ্টি করছে। কষ্টের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই হাল হাতিয়ার তৈরি করছে, প্রতিরোধ করছে। নতুন নতুন ধারণার জন্ম দিচ্ছে।যেটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে (পাওয়ার অব ট্রান্সলেশন অব দ্যা হিউমেন ব্রেইন)” ফলে মানুষের দায় দায়িত্ববোধটাও পশু, পাখি, জীবজন্তু থেকে অনেক বেশী। যা জন্তু, জানোয়ারের সাথে মানুষের পার্থক্য এঁকে দেয়। মানুষ ইচ্ছা করলেই যখন তখন যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। তাকে তার দায়-দায়িত্ববোধ দিয়ে, বিচার বিবেচনা, বিবেক বুদ্ধি দিয়ে, আবেগ অনুভূতি দিয়ে কাজ করতে হয়। তা না হলে সে আর নিজেকে মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতে পারে না। এতো গুলো কথা বললাম কেন? বললাম এই কারণে যে লালন ভারতবর্ষের মানুষ এই পূর্ব বাংলার মানুষ, এদেশের মাটি, পানি, বাতাস, আবহাওয়ায় গড়ে উঠা প্রাণ পুরুষ। রক্তে মাংসে এই দেশেরই মানুষ, তিনি আকাশ থেকে পড়েননি, মাটি খুঁড়ে বের হননি। তাঁকে অনুধাবন করতে হলে এই বিষয়গুলো অনুধাবন করে আলোচনা করতে হবে। মানুষ বলে বাঙালির মনন জগতে বড় কোনো মানুষ নাই! কিন্তু তলিয়ে দেখলেই দেখা মেলে। বড় চরিত্রের মানুষ আছে।

কেননা মানুষের প্রতি মানুষের বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক মানুষই সৃষ্টি করেছে। মানুষদের বৈচিত্র্যময় সম্পর্কই তৈরি করেছে পৃথিবীর যতরকম বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য। আর সৌন্দর্যের খুব কাছের শব্দ শিল্প। শিল্প ছাড়া সৌন্দর্য আসে না। তাই শিল্প সম্পর্কে বলতে হলে আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে শিল্পবোধ। আর শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষ সবসময়ই সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল। শিল্প একটা ধ্রুব যা সৌন্দর্য এবং কুৎসিত, মূর্ত এবং বিমূর্ত, জীবন্ত এবং মৃত, প্রচ্ছন্ন এবং পরিচ্ছন্ন, উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট, উৎপাদনশীল এবং অনুৎপাদনশীল, কালো এবং সাদা, সত্য এবং মিথ্যা, এইরকম হাজারো পরিবেশ পরিস্থিতি দ্বারা শিল্প আবৃত, অনাবৃত অনেক সময় প্রভাবিত।কিন্তু মানুষ সেটাকে কিভাবে দেখবে? মানুষ তার সহজাত প্রবৃত্তি এবং প্রকৃতির কারণেই সহজ সত্য এবং সৌন্দর্যের পূজারী। ফলে মানুষ শিল্পকে দেখে সত্য এবং সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে।

আরও পড়ুনঃ  ত্বকের যত্নে মসুর ডাল

এজন্য প্রয়োজন সহজ সত্য, সৌন্দর্যমন্ডিত, শিল্পসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি যেটা তাকে বিপরীতধর্মী শিল্প সত্য সত্তায় কুৎসিত কালো পাথর থাকা সত্ত্বেও সৌন্দর্য উপভোগ করতে সহয়তা করে। এই সৌন্দর্য বোধ, শিল্পবোধ লালন সারাজীবন তার জীবনে চোখের মনির মতো যত্ন করেছেন, সাধনা করেছেন।

মানুষের বাহিরে অন্য কোনো পশুজীব এই বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক এবং শিল্প সৃষ্টি করতে পারে না। তাদের মধ্যে শিল্পময় এবং সৌন্দর্যময় চিন্তা এবং সৌন্দর্যমন্ডিত বোধ উপলব্ধিটাও আসে না। কারণ তাদের মননকাঠামো নেই।নেই চিন্তা করার ক্ষমতা। নেই ভালোমন্দ বিবেকবোধ, অপরাধবোধ,আত্মসম্মানবোধ, নেই বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা। কিন্তু মানুষের মনন কাঠামো রয়েছে, রয়েছে চিন্তা করার ক্ষমতা, সঠিক বেঠিক খুঁজে বের করে আনার ক্ষমতা, রয়েছেনগভীর অনুসন্ধানী মন। মানুষ যেটাকে কাজে লাগিয়ে হিমালয়ের ধনধারা সমতল ভূমিতে নিয়ে আসতে পারে। তাই মানুষের দায় দায়িত্ববোধ অনেক বেশী। চারপাশকে সুন্দর রাখা, সুস্থ রাখা, সময় অসময়ে তাদের পরিবর্তন করাও মানুষের কর্তব্য হিসেবেই গুরুত্ব পায়।

দুটি দিক থেকে মানুষের দায়-দায়িত্ব বোধ জরুরি। প্রথমত মানুষ মানুষেরা সাথে এমন এক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ যা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের একটি পরম্পরাগত অংশ, দৈহিক এবং ভাবগতভাবে। কোন একজন মানুষ এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যাওয়া মানে গোটা মানব সমাজের অর্জিত সকল সম্পর্কের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা মানে নিজের বিকাশের সকল দরজা বন্ধ করে রাখা। যা সমাজের জন্য অন্যায়, নিজের জন্য তো আরো বেশী অন্যায়। যা একধরণের মানসিক আত্মহত্যার সামিল। তার মানে হচ্ছে মানব সভ্যতার দীর্ঘ ক্রমবিকাশের রাস্তায় না হেঁটে অর্ধপথেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়া। তাই মানুষ কখনো সমাজ সভ্যতা এবং পারপার্শ্বিক পরিবেশ, পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে না।বড় চরিত্রের মানুষ যাঁরা তাঁরা তো পারেনই না। লালনও পারেন নি।

মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র বিকাশের প্রধান অন্তরায় ধনী গরীব বৈষম্য। যাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় হাজারো বৈষম্য-জাতপাত, বর্ণ, কালো, ধলো, উঁচুনিচু, নারী পুরুষ, আঞ্চলিকতাসহ অসংখ্য বিভক্তি। ধনী, দরিদ্র বৈষম্য শুধু মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অর্থনৈতিক সংকটই তৈরি করে না, মানুষের আদর্শিক, নৈতিক মনোভাব, আত্মিক মনোবল ধ্বংস করে দেয়।

ফলে লালনকে মূল্যায়ণ করার পূর্বে দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিষ্কার হওয়া জরুরী। লালন যত বড় মানুষই হোন না কেনো, তিনি তৎকালীন অবস্থিত আর্থসামাজিক ধনী-গরীব শ্রেণী বিভক্ত সমাজে যেকোনো শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। এর বাহিরে লালনকে মূল্যায়ণ করা মানে তাকে অবমূল্যায়ন করা। পাশাপাশি তৎকালীন অবস্থিত বাস্তবতার স্থান, কাল, পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। লালন কোন শ্রেণীর প্রতিনিধি? সমাজের সকল মানুষ এক শ্রেণীভুক্ত নয়। আমরা কোন মানুষের মূল্যায়ণ চাই? আমরা কোন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির বিকাশ চাই? কাদের উন্নতি চাই? দাসেরা একরকম চিন্তা করে, গরীবেরা একধরণের চিন্তা করে, স্পৃশ্য অস্পৃশ্যরা আরেক ধরণের সংস্কৃতি বহন করে।

হিন্দুদের একধরণের জীবন সংস্কৃতি, মুসলমানদের একধরণের সংস্কৃতি, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টিয়ানদের একধরণের সংস্কৃতি। অন্যদিকে ধনীদের, মালিকদের একধরণের জীবন-সংস্কৃতি, ধর্ম ব্যবসায়ীর একধরণের জীবন সংস্কৃতি, মোনাফেকের এক ধরণের রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রতারকের একধরণের রাজনীতি, সংস্কৃতি, মিথ্যাচারীর একধরণের সংস্কৃতি, অন্য দিকে গরীব দুঃখী অসহায় দরিদ্র মানুষ, তাঁতি, মজুর, কৃষক অসহায় নিষ্পেষিত মানুষের এক ধরণের রাজনীতি, সংস্কৃতি। একদিকে জালেমের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অন্যদিকে মজলুমের রাজনীতি, সংস্কৃতি। আমরা কোনটা চাই? লালন শাহ কোন পক্ষের প্রতিনিধি? আর আমরা কার পক্ষের মানুষ? নাকি আমরা নিরপেক্ষ? নাকি লালন নিরপেক্ষ? নিরপেক্ষ তো ধূর্ত, কপট, মিথ্যুক, প্রবঞ্চক, চালবাজ, সুবিধাবাদী, মোনাফেকও! তাহলে লালন কোন সংস্কৃতির প্রতিনিধি?জালেমের নাকি মজলুমের? এই প্রশ্ন উপেক্ষা করে, চালাকি করে লালনকে মূল্যায়ণ করা যাবে না। যাদের খুঁটির জোর কম তারাই তো লালনকে নিয়ে টানাটানি করে।লালন কি টানাটানির বস্তু?

যে দেশে হিন্দুর রচনায় কেবল হিন্দুই মিলে, মুসলমানদের রচনায় মিলে মুসলিম সে দেশে কোনো অবস্থায়ই দেশ, কাল, জাতি, লিঙ্গ নিরপেক্ষ আলোচনা আসতে পারে না! লালনকে স্বরূপে পেতে হলে শাস্ত্র, সংস্কার, বিশ্বাস, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদ নীতি, আদর্শ, নিয়ম, লিঙ্গ, অঞ্চল, জাত, কুল, দেশ নিরপেক্ষ মানুষের বৃত্তি, প্রবৃত্তি, সংযম, সহিষ্ণুতা, বিবেক বুদ্ধি মনুষ্যত্বের নিরূপণ করে আসতে হবে।

লালনের গোটা জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাঁর জীবনদর্শনে লুকিয়ে আছে তিনটি জিনিস এক তার ভাষাগত জ্ঞান, দ্বিতীয় তাঁর জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা, তৃতীয়ত তার সাহিত্য রসবোধ।

দেহাত্মবাদী, নিরীশ্বরবাদী বাঙ্গালী হিসেবে লালনের আবির্ভাব। যার ধ্বনি, শব্দ, বাক্য, ছন্দ এবং গানের মুর্ছনায় রয়েছে মানুষ, প্রাণীজগৎ,জীবজগৎ, বস্তুজগৎ,প্রাণ প্রকৃতি,মাটি পানি,আলো, বাতাস,নদী, পাহাড়, স্রোতধারা,পাখির কথা। আছে মানুষে-মানুষে বিভেদ, বৈষম্য নিরসনের কথা।

পন্ডিত ব্যক্তি আহমদ শরীফ বলেন, “বৌদ্ধ সহজিয়ার ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের কালে দুটি আলাদা পথে রুপান্তরিত হয়, বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যে যারা বামাচারী তারা হয়েছিলেন বৈষ্ণব সহজিয়া, তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনাকে বজায় রেখে যারা বৈষ্ণব ধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বৈষ্ণব সহজিয়া বা রসিক বৈষ্ণব। প্রজ্ঞা -উপায়ের পরিবর্তে রাধাকৃষ্ণ প্রতীক সাধনা চৈতন্য -পূর্ব যুগেই হয়তো শুরু হয়েছিল। কিন্তু চৈতন্যোত্তর রাধাকৃষ্ণ প্রতীকে সাধনা চৈতন্য -পূর্ব যুগেই হয়তো শুরু হয়েছিল। চৈতন্যের একটিরই লোক প্রচলিত নাম বাউল সম্প্রদায়।যে সব লোক প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল, আর যে সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্ব পুরুষের ধর্মাচারণ করেছিল তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উত্তরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে। “

আরও পড়ুনঃ  বর্ষায় কাপড়ের ভেজা গন্ধ দূর করার উপায়

তথাকথিত হিন্দু সাহিত্যিকদের সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা আর মুসলিম সাহিত্যে মুসলমানদের পক্ষপাতিত্বে আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহারের ভিত্তিতে পুঁথিগুলো রচিত হতো। একে দোভাষীও বলা হয়।এইসব ভাষা এবং লেখা জনগণের ভাষা ছিল না। বাউলদের তো ছিলই না।সংস্কৃত এবং আরবি ফারসী মূলত ছিল বিদেশী বিভাষী শাসকদের ভাষা যা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানরা রপ্ত করেছিল প্রসাশনিক প্রয়োজনে। সাধারণ জনগণের মুখের ভাষা, সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন, সাধারণ মানুষের জল্পনা কল্পনা, স্মৃতি মূল্যবোধ, জীবন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ফুটে উঠেছে মূলত বাউল গান আর লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে।

বাংলার মধ্যবিত্ত হিন্দু মুসলমানদের সংস্কৃত এবং আরবি ফার্সী ভাষা দাপ্তরিক এবং সাহিত্য পঠন পাঠনের বাহুল্যের কৃত্রিমতা কীভাবে পরিহার করা যেত তার একটি মাইল ফলক লালন শাহ(১৭৭২-১৮৯০)। তিনি দেখিয়েছেন ভাষা কীভাবে মানুষের মুখে মুখে গানে পরিণত হয়। ভাষা কতটা গতিশীল এবং বৈপ্লবিক।
লালন শাহ এবং রামমোহনের একই বছর জন্ম। কিন্তু রামমোহন কলকাতায় আর লালন কুষ্টিয়ায়।রামমোহনের সাথে লালনের দেখাও হয়নি কখনও। লালন যে ভাষাতে গান রচনা করেছেন তার সঙ্গে রামমোহনের ভাষার কোনো মিলই নেই।লালনের ভাষা সহজ সরল প্রাঞ্জল সুমধুর গভীর এবং চিন্তক।এই ভাষার সঙ্গে এ দেশের জনগণের ভাষার মিল আছে যা কলকাতার শিক্ষিত মানুষের প্রস্তুতকৃত গদ্যের ভাষার কোন মিলই নেই।কলকাতা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বইয়ের ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল না। লালনের ভাষা ছিল একদিকে জনগণের মুখের ভাষা অন্যদিকে লালনের ভাষার গতি নদীর মতো, উদারতা আকাশসম এবং তীব্রতা বহমান বাতাসের মতো।লালনের গানে প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা আছে, আছে দার্শনিকতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা।পাওয়া যাবে না কৃত্রিমতা।

লালনের গানে দেহতত্ত্বের চিরায়ত পথে লালন ক্রমে নিজস্ব একক স্বাধনা ও উপলব্ধি নিয়ে এসেছিলেন। দার্শনিক চিন্তা জগতে লালন যতই প্রবেশ করেছেন ততোই তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছেন। রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক হিন্দু মুসলমান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পার্থক্য বিভেদ বৈষম্য দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত সমাজ অভ্যন্তর থেকেই লালনের সৃষ্টি।লালনের চিন্তাভাবনা থেকে ক্রমেই খসে পড়েছে প্রচলিত ধর্ম, আচার, মন্ত্র, শাস্ত্র। ছেঁউড়িয়ার নির্জন নিন্মবর্গের মানুষ, বিশেষ করে মাঝি মাল্লা, কৃষক তাঁতি দরিদ্র অসহায় শোষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বনির্বাসী মানুষটি আপন অন্তরের অনুজ্ঞায়, আপন মনের একতারাতে গান বেঁধেছেন। গানই তাঁর জীবনে সত্য ও জীবন চেতনার ক্রম অভিব্যক্তির ক্রমাগ্রসর নজির।

আজ এতো দিন পর লালনের সে সব গান কালানুক্রমে সাজানো যাবে না। সাজানো গেলে বাংলার একজন বড় মাপের সাহিত্যিক আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা যেত, যা রবীন্দ্র- নজরুল থেকে কোন অংশেই কম নয়। প্রকৃত অর্থে লালনের কোনো শিক্ষিত সচেতন শিষ্য ছিল না যারা এগুলো সংরক্ষণ করতে পারতো। বেশীরভাগ শিষ্যের ধারণা ছিল লালন তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও গ্রহণ ক্ষমতায় প্রখর চিন্তাশীল ও সুরের সাধক। তাঁর রেখে যাওয়া অমূল্য গানের পরম্পরা তারা বিন্যাস করে পর্বে পর্বে বুঝে গাইতে এবং প্রচার করতে পারেনি। লালনের গানের অর্থ গভীরতা মূল্যায়ণ করার মতো যথার্থ কোনো মানুষ তাঁর পাশে ছিল না, যারা ছিল তারা তা মুখে মুখে, সুরে সুরে আত্তস্থ করেছে ঠিকই।

কিন্তু গানের ভেতর প্রবেশ করতে পারে নি। লালন কোনো সংগীত বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। গানের গাঠনিক কোনো মৌলিকতার প্রয়াস না নিয়ে লালন তাঁর গানকে সমৃদ্ধ করেছেন ভাবসত্যে, তীর্যক বক্তব্য এবং শব্দ ব্যবহারে দ্যোতনাবহুল দীপ্ত কুশলতায়। যেমন তার ভাবনা, তেমনি তার প্রকাশভঙ্গি। যুগের বিচারে লালন ছিলেন অত্যন্ত স্বকীয় ও আধুনিক। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যা তাঁকে শক্তিশালী করেছে তা হলো তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞা।

প্রখর যুক্তিবাদী লালন প্রশ্ন তুলেছেন জাতিবর্ণ সম্পর্কে, তাঁর অবিশ্বাস ছিল বহু প্রকারে; বিশেষ করে শাস্ত্র, দেহ-মূর্তি পূজা,নামাজ বিধি, মন্দির মসজিদ, তীর্থ-ব্রত, উপবাস এবং বৈরাগ্যসাধনে। লালন ছিলেন নিঃসঙ্গ কিন্তু ছিলেন না বিচ্ছিন্ন। তিনি নিন্ম বর্গের কৃষিজীবী মানুষকে আচারসর্বস্ব কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস থেকে জীবনের দেহগত চর্চায় টানতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে প্রতিকূলতা তাঁর প্রতিবন্ধক হয়েছিল। তবুও তাঁর ব্যক্তিগত সাধুতা, জীবনযাপনে গভীর নিষ্ঠা এবং অসামান্য গান রচনার প্রতিভা সমকালে লালনকে এক ধরণের মহত্ত্ব মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু তার সংঘ,সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস ছিল না।শেষ মধ্য যুগে সেই ধূসর গ্রামীণ সমতলে লালন যেন এক প্রবাহমান নদী যার জল পানে সকলের প্রাণ জুড়ায়।কেননা তাঁর গানে রয়েছে এ দেশের মাঝি মাল্লা, কৃষক, বর্গাচাষী, দিনমজুর, ক্ষেতমজুর, নিরন্ন, অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ জনগোষ্ঠীর আত্মকথা। তাদের জীবনের দীর্ঘশ্বাসের কথা ভাষা দিয়েছেন লালন।একদিকে কষ্টের কথা, মূল্যবোধের কথা অন্যদিকে রয়েছে জিজ্ঞাসা। প্রতিবাদ রয়েছে প্রশ্ন করে করে।এসবের সংমিশ্রণেই তৈরি হয়েছে লালনের বাঙ্গালি সংস্কৃতি।

ভালো করে লালনগীতি শুনলে দেখা যায় গানের মূল ভিত্তিতে আছে আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, এবং বস্তুতত্ত্ব। উনিশ শতকীয় নবজাগরণের সঙ্গে উচ্চারিত যেসব ব্যক্তি মনীষীদের আমরা জানি বিশেষ করে রামমোহন, বিদ্যাসাগর,অক্ষয়কুমার, দেবেন্দ্রনাথ, মাইকেল,বঙ্কিম, রমেশচন্দ্র, কেশবচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র প্রমুখ সকলেরই অর্থনৈতিক স্বকীয়তা ছিল। ছিল ইংরেজি শিক্ষার পরিশীলিত আভিজাত্য। ব্যতিক্রম ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অশিক্ষিত কিন্তু আত্মা স্বশিক্ষিত।

তবুও তাঁর উত্থান এবং প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল রাণী রাস মনীর সহযোগিতা এবং কেশবচন্দ্র, বিবেকানন্দের মতো প্রভাবশালী উচ্চশিক্ষিতের সমর্থন ও প্রচার। কিন্তু লালন ফকির? তাঁকে প্রায় সকলেই নিরক্ষর অশিক্ষিত পল্লীবাসী বলে রায় দিয়েছেন। তাঁর ধর্ম সাধনার ধারাও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শাস্ত্রানুসারে চলে নি। তাঁর গানে ও কথায় কী ছিল?ছিল সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মের গোপন সব সুনিশ্চিত তথ্য উপাত্ত। তা যেনো লোহা আর পাথরের সংঘর্ষে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

গোটা ভারতবর্ষেের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকে তাকালে দেখা যাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়, জাত পাত, বর্ণের উত্থান পতন আর সম্প্রসারণের ইতিহাস। লালন ছিলেন ব্যতিক্রম। লালন এই তথাকথিত ধারা থেকে বের হয়ে মানুষের কাছে আসতে চেয়েছেন। প্রকৃতির সৃষ্টি রহস্য, মানবসৃষ্ট বৈষম্যের পেছনের রহস্য উদঘাটনে যতরকম বাধা ছিল তাকে ডিঙ্গনোর চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  এই গরমে অতিরিক্ত ঘাম হলে করণীয়

লালনের বাংলা ভাষাগত জ্ঞান এবং ভাষার গতিময়তা প্রকাশ পায় এতো সব সহজ সত্য ছন্দ গভীরতায় যেখানে শব্দ এবং বাক্য রয়েছে প্রকৃতির মতো সুবিন্যস্ত। কয়েকটি গানের কলি দেখলেই অনুমান করা যায়…

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়, ধরতে পারলে মনবেড়ী দিতাম তাহার পায়, বাড়ির কাছে আর্শীনগর, আমার ঘরের চাবি পরের হাতে, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন কয় জাতের কিরূপ দেখলাম না এই নজরে, সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সময় গেলে সাধন হবে না,

ভাষার ক্ষেত্রে লালন খুবই প্রগতিশীল। কিন্তু লালনের ভাষা বাংলা সাহিত্যে জায়গা পায় নি। কারণ লালন রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে ছিলেন। তাঁর ভাষা সাহিত্যের ভাষা হবে কোন যোগ্যতায়? কিন্তু লালনের ভাষা সাহিত্যের ভাষা হলে বাংলার সাহিত্য হতো আরও গতিশীল হয়তো হতো আরও বৈপ্লবিক। সংস্কৃতিও হতো সমৃদ্ধ। তাতে ভয় ছিল সমাজ অধিপতিদের। কেননা সমাজ অধিপতিরা ভাষা নিয়ে রাজনীতি করেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনেছেন ভাষা দিয়ে। ঔপনিবেশিক শাসক শোষকদের ছায়াতলে মধ্যবিত্ত হিন্দুরা যখন সংস্কৃত ভাষা গ্রহণ করেছে তখন মধ্যবিত্ত মুসলমানরা তা বর্জন করে আরবি ফারসী ভাষা স্বগোত্রের ভেবে গ্রহণ করেছে। দুটোই ছিল কৃত্রিম। যার ফলে ধর্মকে কেন্দ্র করে ভাষার চর্চা করতে গিয়ে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়েছে, হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব ঔপনিবেশিক শাসক প্রশাসকরা উসকে দিয়েছে, ফলে মাঝে মাঝেই কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে।পরবর্তী সময় গোটা ভারতবর্ষকে ভাগ করতে হয়েছে কৃত্রিম দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে।

কিন্তু লালন এরকম কলহে যেতে চাননি। তিনি এই কলহের গোড়ায় বরং আঘাত করেছেন স্বজোরে। আপন সৃষ্টিতে সাম্যের দৃষ্টিতে সমাজকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন।

যে সময় লালন গান লেখেন সেই আঠারো উনিশ শতকে বাংলা গানের তেমন সুসময় নয়।আটশো বছরের গীতি পদাবলীর সংস্কার ভেঙ্গে বাংলা সুরহীন পাঠ্যকবিতা তখন সবে রূপ নিচ্ছে ঈশ্বর গুপ্ত, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র মধুসূদনের প্রচেষ্টায়।তাদের কাব্যের বেশীরভাগ মডেল বিদেশ থেকে আনা বিভাষী বিজাতী ভাষা, সংস্কৃতি, বিষয়বস্তু বহুক্ষেত্রে প্রতীচ্য প্রভাবিত। কিন্তু বাঙ্গালির নিজস্ব গান তো বিদেশি আদর্শ দ্বারা গড়ে উঠতে পারে না।তাই দেশজ স্বীমাবদ্ধতা মেনে বাংলা গান সে সময় কোনোরকমে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছে।রবীন্দ্রনাথের আত্মভাবপ্রধান খাঁটি স্বরলিপির সূচনা আর নজরুলের সংহত শক্তিশালী চেতনাই বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ যদিও বলেছেন, “প্রাণহীন এ দেশের পরিবেশ সত্যিই গানহীন ছিল।”
কারণ গড়পড়তা বাংলা গান কেবল পাঁচরকম রূপবন্ধে আবদ্ধ ছিল। কীর্তন,কবিগান, টপ্পা, শ্যামা বিষ, আর বাউল গান। এর মধ্যে শ্যামা ও রামপ্রসাদী গান ছিল ধর্মশাস্ত্রকে কেন্দ্র করে। টপ্পা ছিল প্রণয় সংগীত, কবিগান ছিল রাধাকৃষ্ণের কলঙ্ক ও ছলনা ভরা।

অর্ধশিক্ষিত জনগণের মানসিক অবক্ষয়ের রুচিহীন উৎসাহ যোগাতো এসব গান। পদাবলীও বৈচিত্র্য হারাচ্ছিল তখন। একমাত্র বাউল গান ছিল অপেক্ষাকৃত আত্মমুখী আর ব্যক্তি আকাঙক্ষার প্রকাশ যেখানে রয়েছে প্রশ্ন যুক্তি এবং জীবন জগৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা।

আমাদের জারি, সারি, মুর্শীদি, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ভাটিয়ালি তখনও আঞ্চলিকতা অতিক্রম করে তেমন প্রসার প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। লালনকে তাই বাউলজাত গানের আঙ্গিক প্রবর্তন করতে হয়েছে। কারণ ছিল সমাজ। সমাজের অভ্যন্তরে ধর্মীয় বিভেদ এবং সাম্প্রদায়িকতা যার প্রভাব ভাষায়, গানে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে। বাঙালির ইহজীবন সর্বস্ব ভোগবাদের চেয়ে বৈরাগ্যপ্রিয় আঠারো শতকের বৌদ্ধ ধর্মের প্রচ্ছন্নতা বাঙ্গালীকে আকৃষ্ট করেছে। কৃষক বিপ্লবের ব্যর্থতা, গ্রামীন সমাজের অর্থনৈতিক শাসন শোষণের চাপ, সামন্ত সমাজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি কর্মের আনন্দের চেয়ে কর্মহীন, প্রশ্নহীন আধ্যাত্নবাদকে শক্তিশালী করে তোলে। যার প্রভাবে পরবর্তী সময়ে লালন শিষ্যগণ ইহজাগতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আখড়াকেন্দ্রিক, তন্ত্রাচারী যোগী হয়ে উঠেন।

কিন্তু তৎকালীন সময়ে লালন জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তিনি সবসময় বড় আশ্রয় পেয়েছিলেন শ্রমিক, তাঁতি, কারিগর, মাঝিমাল্লা ও কৃষকদের কাছে। সংসার সমাজের ঘাতপ্রতিঘাত তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, তারপরও তিনি সমাজ বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত ভ্রমনপ্রিয় মানুষ ছিলেন, তানাহলে জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিদ্বগ্ধ অভিজাত মানুষ লালনের স্কেচ এঁকেছিলেন শিলাইদহের বোটে তাঁকে সামনাসামনি বসিয়ে। এমনই ছিল লালনের আকর্ষণ। শিলাইদহের অন্তর্গত খোরশেদ পুরের সাধক গোসাই রামলাল (১৮৪৬-১৮৯৪) মাঝে মাঝেই ছেঁউড়িয়ায় লালন ফকিরের সঙ্গে দেখা করতে ভাব বিনিময় করতে যেতেন। জমিদার দর্পনের মীর মোশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) ছিলেন লালন অনুরাগী। লালনের জীবনী যিনি প্রথম লিখেন বসন্ত কুমার পাল লালনের ভাবাদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। লালনের গান এবং ভাষার প্রভাব ছিল রবীন্দ্র সংগীত এবং সাহিত্যে।

লালন শাহ শাস্ত্র এবং ধর্মের চেয়ে লোকধর্ম অনেক বেশী জেনেছেন। লোকধর্মে সবচেয়ে বড় স্থান পায় অনুমানের চেয়ে বর্তমান, পরলোকের চেয়ে ইহলোক, আত্মার চেয়ে দেহ, মন্ত্রের চেয়ে গান,ঈশ্বরের চেয়ে গুরু। তারা মেনে নেন মাটি আর মানুষ, বীজ আর জমি, নর আর নারী, উর্বরতা আর প্রজনন। বোঝাই যায় লোকধর্ম জন্মই হয়েছে দ্রোহ বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে তার ভিতরে রয়েছে জাতপাত বৈষম্যের আঘাত।কিন্তু লালন পরবর্তী সময়ে লোকধর্মের জাতপাত, শাস্ত্র, প্রতিমা, মন্দির, মসজিদ, ফতোয়া, পুরোহিত বর্জনকে কেন্দ্র করে কলহ বাধিয়েছে এক ধরণের স্বার্থান্বেষী মহল। আরও দুঃখের বিষয় হলো লোকধর্মের অনুসারীরা এখন খাজনা বাজনা আর জরিমানা নিয়েই ব্যতি ব্যস্ততার মধ্যে সময় পার করেছেন। কিন্তু এমনতর লোকধর্মে লালন আশ্রয় গ্রহণ করেননি। তিনি মানুষ, সমাজ এবং সমাজের সকল রকম বৈষম্য, বিভাজন, জাতিভেদের গোঁড়ায় আঘাত করে মানবতার কথা প্রবর্তন করেছিলেন যা ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ এবং ইহজাগতিক মানবতাবাদ।

লেখক: মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন
লেখক ও কলামিস্ট

আনন্দবাজার/শাহী

সংবাদটি শেয়ার করুন