মো. জামাল হোসেন
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে কিছু দালাল এবং বিশ্বাসঘাতকের কারণে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সেই থেকে প্রায় ২০০ বছর বিট্রিশরা শাসন করে এই বাংলা। বাঙালির ইতিহাস জানতে এবার একটু পিছনে ফেরা যাক।
হাজার হাজার বছর ধরে নানা জাতির মিলনমেলা ঘটেছে বাংলায়। বাংলা দখল করতে এসেছে নানান বিদেশি শক্তি। বাণিজ্য, ধর্ম প্রচার, ডাকাতি এবং চাকরি- একেকজন একেক উদ্দেশ্যে এসেছে। স্থানীয়দের সঙ্গে এদের বিয়েশাদি হয়েছে। এভাবে নানা রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। আর এই দীর্ঘ মিশ্রণের মধ্য দিয়েই শংকর জাতির বাঙালি নিজের পরিচয় স্পষ্ট করেছে। এসব আগমনী শক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসন করেছেন।
বাঙালি জাতি নিয়ে নৃ-বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম। দুনিয়ার বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে। অনেকে আবার বেরিয়েও গেছে। তবে পেছনে রেখে গেছে তাদের আগমনের দলিল। তাই বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু এবং বিচিত্র সব নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব।
জাতিতাত্ত্বিক নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। নরগোষ্ঠীগুলি হলো- নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অষ্ট্রেলীয়। বাংলার প্রাচীন জনগুলির মধ্যে অষ্ট্রিক ভাষীরাই সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার বছর আগে এই বাংলায় অস্ট্রিক জাতি এসেছিল। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই আদি জনগোষ্ঠীগুলি দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পর।
বাংলাদেশের জনপ্রবাহে মঙ্গোলীয় রক্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির রক্তে নতুন করে মিশ্রণ ঘটল পারস্য-তুর্কিস্তানের শক জাতির আগমনের ফলে। বাঙালি রক্তে বিদেশি মিশ্রণ প্রক্রিয়া ঐতিহাসিককালেও সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিকযুগে আমরা দেখি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখতে।
গুপ্ত, সেন, পাল, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মুগল, পর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল। আর রেখে গেছে তাদের রক্তের ধারা। এমনকি পাকিস্তান যুগেও আমরা দেখি রক্ত মিশ্রণের চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এই শংকরত্ব আরো বেগবান হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, বাঙালি একটি শংকর জাতি।
প্রকৃতিও এই অঞ্চলের মানুষদের শংকর ভাবাপন্ন করেছে। আমাদের ষড়ঋতুর দেশ। আমরা একেক ঋতুতে একেক আচরণ করি। ষড়ঋতু বাংলার বুকে নেমে আসে আলাদা রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ ও ছন্দ নিয়ে। এই বৈচিত্র্যের কারণে মনের ওপর ষড়ঋতুর প্রভাব বিচিত্রধর্মী। ষড়ঋতু নানা রঙের জাল বিস্তার করে আমাদের সবার মনে। কোন ঋতু আমাদের আনমনে করে দেয়। কোন ঋতু প্রেমিক বানিয়ে দেয়। কোন ঋতু কাব্যিক করে দেয়।
ব্রিটিশ শাসন শেষে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাভ করল স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এ যুদ্ধে অংশ নেয় বাংলার সর্বস্তরের মানুষ। বিজয়ের পরেই যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গড়ায় মনোনিবেশ করেন জাতির পিতা। তবে কিছু গোষ্ঠি জড়িয়ে পড়লো লুটপাটে। কিছু জড়িয়ে পড়লো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে। কেউ চাইলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে। একটি পক্ষ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।
বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ সামাজিক মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে। ভাষণটি এমন- ‘এত চোরের চোর। চোর কোথা থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে; কিন্তু এ চোরগুলো রেখে গেছে আমার কাছে। এ চোরগুলো নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম। শতকরা বিশজন লোক শিক্ষিত। তার মধ্যে শতকরা পাঁচজন আমরা বলতে পারি উচ্চশিক্ষিত।
আজকে একটা প্রশ্ন আমার, এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? নাহ্। আমার শ্রমিক? নাহ্। তাহলে কে? ঘুষ খায় কারা? স্মাগলিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান করে কারা?
এই আমরা যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত লোক, এই আমাদের মধ্যে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ এবং এই আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মসমালোচনা করতে হবে। এসব দুর্নীতিবাজ এই শতকরা পাঁচজনের মধ্যেই, এর বাইরে নেই।
কেন নেই? কারণ আমার কৃষক দিনভর পরিশ্রম করে। শিক্ষিত সমাজকে আজ একটি কথা বলব, আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি।’
এসব কথা বলছি করোনাভাইরাসের মতো মহামারীর সময়ে। আমরা আজব এক জাতি। চরিত্রের কোন ঠিক নেই। প্রকৃতির মতোই রুপ বদল করি। আমাদের নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। বাণিজ্য আর ধান্ধাবাজির সুবিধা চাই। সময় বুঝি না। মানবিক বোধ নেই। রবি ঠাকুর ঠিক বলেছিল, ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’
দুনিয়া এখন টালমাটাল করোনায়। এই মহামারীর যুদ্ধে পুরো দুনিয়ার সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। আর বাংলাদেশে একটি পক্ষ করোনায় সুযোগ খুঁজছে। সরকার ব্যর্থ হলেই বুঝি ওই পক্ষটি খুশি হবে। পক্ষটি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুজব ছড়াচ্ছে। নানা অসহযোগিতা করছে। সরকারকে অপবাদ দিয়ে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই পক্ষটির কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, ওরা বসেই ছিল এমন অভিশাপী মহামারীর জন্য। ছি, আপনাদের জন্য লজ্জা হয়। এতো নিচু মানসিকতার আপনারা।
আবার সরকারের ভেতরে একশ্রেণির চোর ত্রাণের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিচ্ছে। কোন এলাকায় রাজনৈতিক দলাদলির ফাঁয়দা নিতে একনেতা অন্যনেতাদের বিরুদ্ধে লেগেছে। অপপ্রচার চালাচ্ছে নিজ দলের লোকের বিরুদ্ধেই। এমন অপপ্রচারে জনরোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এদের দেখে স্পষ্টই জাসদি মনোভাবের মনে হচ্ছে। জাসদও একই কাজ করেছে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে। হতাশার কথা, বর্তমান সরকার দলের মধ্যে এখনো জাসদিরা রয়ে গেছে।
আমার দেশের অনেক নেতার বিষয়ে শুনি, উনি উমুক দেশের দালাল। তিনি তমুক দেশের দালাল। মানে কেউ ভারতের দালাল। কেউ পাকিস্তানের দালাল। কেউ আবার রাশিয়া, আমেরিকা কিংবা চিনের দালাল। আমার কথা হচ্ছে, এতো কষ্টে অর্জন করা আমার সোনার বাংলার দালাল কই? করোনারভাইরাসের মতো সংকট ঠেকাতে হলে দেশপ্রেম লাগবে। আর এটির জন্য বাংলাদেশের দালাল হতে হবে। আমি বাংলাদেশের দালাল হতে চাই।
আর একটি কথা, মহামারী নিয়ে রাজনীতি করবেন না। কোন পক্ষই এই কাজটি করবেন না। টিকে থাকলে, বেঁচে থাকলে বহু রাজনীতি করতে পারবেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক চন্দ্রগুপ্তের এক দৃশ্যে মহাবীর আলেকজান্ডার ভারতে প্রবেশ করার পর ভারতের বিচিত্রতা দেখে বলে ওঠেন, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ।’ আসলেও আমরাও বিচিত্র। বাঙালির করোনার মতো হাজারো জিনের মিশ্রণ। এজন্যই ক্ষণে ক্ষণে আমরা রুপ বদলাই।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এটি যেনো দীর্ঘদিন মুনাফার পাহাড় গড়া ব্যবসায়ী না পায়।
ধরা যাক, একজন ২০ বছর ধরে ব্যবসা করে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন। আবার কেউ ২/৩ বছর ধরে ব্যবসা করে একটু দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। প্রণোদনার টাকা দ্বিতীয় পক্ষকেই দেয়ার অনুরোধ করছি। প্রথম পক্ষ লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে। দ্বিতীয় পক্ষ প্রণোদনা না পেলে হারিয়ে যাবে। ছোট ব্যবসায়ীদেরও এই প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে। কৃষিখাতে, স্বাস্থ্যখাতে প্রণোদনা দিতে হবে।
দেশে আপদকালীন ফান্ড গঠন করতে হবে। দেশের ছোট, বড় কিংবা মাঝারি সকল ব্যবসায়ীকে আপনকালীন ফান্ড গঠনে বাধ্যবাধকতার জন্য আইন করতে হবে। প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে আপদকালীন ফান্ড গঠন করতে হবে। যাতে মহামারী, দুর্যোগ কিংবা যেকোন আপদকালীন সময়ে ওই ফান্ডের যথাযথ ব্যবহার করা যায়। এতে সরকারের উপর থেকে চাপ কমবে।
মো. জামাল হোসেন
সম্পাদক
দৈনিক আনন্দবাজার