ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দান নাকি ফান

সকল দানেই সওয়াব রয়েছে। প্রকাশ্যে দানে দোষ নেই, তবে গোপনে দান উত্তম। করোনা সংকটে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগও নিয়েছেন অনেকে। বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও দিনরাত মানুষের সেবায় কাজ করছেন।

অনেকেই প্রকাশ্যে দান করে সেটি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছেন। অন্যকে দানে উৎসাহিত করতে এই প্রচার মন্দ না। দানের আসল উদ্দেশ্য- সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করা। দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের মাঝে রিজিকের ভারসাম্যতা রক্ষা করেন।

কোরআনে বলা আছে- ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরো বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সূরা: আল-বাকারা, আয়াত: ২৭১)

করোনার এই সময়ে দান মানে মানুষকে মানসিক সমর্থন। পাশে দাঁড়ানো মানে সৃষ্টিকে ভালোবাসা। আমরা যা দান করি, তা দয়া নয়। এটা অসহায়দের অধিকার। আপনি যখন দান করেন, তখন আপনি সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সম্মানিত করবেন।

গোপনে দান করার বিষয়ে হাদিস বলছে- নবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হচ্ছে, এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

করোনা সংকটে যারা মানুষকে দান করছেন তাদের সাধুবাদ জানাই। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দানের কিছু দৃশ্য দৃষ্টিকটু লাগে। আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের খুব ছোট করে ফেলছি।

এভাবে লেখার ইচ্ছে ছিল না, তবুও লিখলাম। কয়েকদিন আগে আমার ফেসবুকে একটি স্টাটাস দিয়েছিলাম- ‘দান করার সময় ক্যামেরাগুলি বন্ধ রাখলে ভালো হতো। যাকে কিছু দিচ্ছেন তাঁর কিন্তু আত্মসম্মানবোধ আছে। আর কাউকে ডান হাত দিয়ে কিছু দিলে বাম হাত যেনো না জানে- এটাই কিন্তু ধর্মীয় বিধান। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দান করুক। আল্লাহ সবাইকে সমস্ত বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করুক।’

অনেকে হয়তো এই লেখায় মনে কষ্ট পেয়েছেন। কাউকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি লিখিনি। সবার ভুল ভাঙ্গাতেই এই লেখা। অবশ্যই প্রকাশ্যে দান করার মধ্যেও সওয়াব আছে, তবে সেটি কারো সম্মানহানী করে নয়।

একজন ওই লেখায় মন্তব্য করেছিল, ‘কিছু মনে কইরেন না। আমরা দানের ছবি প্রচার করছি ওই সমস্ত লোকদের লজ্জা দিতে, যারা সরকার থেকে এতো বছর সুবিধা নেয়ার পরও এই মহামারীতে ঘরে বসে আছে।’

আরেকজন মন্তব্য করেছে, ‘ক্যামেরার উছিলায় কিছু লোক যদি দান পায় তাও ভালো।’ আসলেই তো। তাহলে ধন্যবাদ ক্যামেরা! তোমার উছিলায় লোকজন কিছু পেলো!

অনেকেই আছেন স্ত্রীকে কোটি টাকার উপহার দেন। তবে মহামান্যদের সেইসব উপহারের ছবি ফেসবুকে দেখি না! খুশি হতাম- যদি কোন নেতা, এমপি, মন্ত্রী কিংবা আমলারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের লাইনে দাঁড় করিয়ে কোটি টাকার উপহার দেয়ার ছবি দিতেন!

একবার ভাবুন তো এটা কী শোভনীয় দেখায়? আসলেই এমন ছবি দেয়া শোভনীয় নয়। যেমন শোভনীয় নয় অসহায়কে দানের নামে সেসব মানুষের ছবি প্রচার করা।

জানা কথা- এসব কথায় যন্ত্রমানবদের কোন দিন লজ্জা হবে না। ওরা বসে আছে অন্য আশায়। বসে আছে ব্যবসায়িক চিন্তায়। ফন্দি আটছে সরকারকে কিভাবে বেকায়দায় ফেলে কিছু আদায় করা যায়। বছরের পর বছর যে হাজার কোটি টাকা আয় করলো সেটা কোন ব্যাপার না। এখন সরকারের কাছে তাদের বায়না, ঋণের সুদ মওকুফ করতে হবে। শ্রমিকদের বেতনের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। কারও দীর্ঘদিন মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকা ফাইল ছাড়তে হবে। কারও নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিতে হবে। এসব শর্ত মানলেই ওরাও নেমে পড়বে করোনা মোকাবিলায়!

সরকারি সহায়তায় হাত দিচ্ছে কিছু চোর। গণমাধ্যমে এমন কিছু খবর আসছে। এসব কারণেই জনপ্রতিনিধি আর স্থানীয় নেতাদের উপর থেকে মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। দেশের মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল শেখের বেটি। এই মানুষটাকে সহায়তা করতে হবে।

প্রত্যেক এলাকায় অসহায় খেটে খাওয়া মানুষের তালিকা করতে হবে। একটি ডাটাবেজ দরকার। সেনাবাহিনী দিয়ে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় এই ডাটাবেজ বানাতে হবে। উদ্দেশ্য একটাই- যাতে ঘরে ঘরে সাহায্য পাঠানো যায়। এটি কষ্টকর হলেও অসাধ্য নয়।

দেশে লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী রয়েছে ২০ লাখের উপরে। একবার চিন্তা করুন- সব ব্যবসায়ী ৫ হাজার করে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিলেও ১০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। অন্যথায় আন্তরিক সহায়তাও তছরুপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, দুঃসময়ে কেউ সুযোগ নিলে, কোনো অভিযোগ পেলে তাকে ছাড়ব না। বিন্দু পরিমাণ অনিয়ম সহ্য করা হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ দেয়ার পরেও অনেক এমপি, মন্ত্রী এলাকায় যায়নি। মানুষের পাশে থাকেনি। সুশীলদের কেউ কেউ আবার ফন্দি আটছে বিদেশি অনুদান বন্ধ করে সরকারকে কিভাবে বেকায়দায় ফেলা যায়। আবার অনেক রাষ্ট্র দানের নামে নিজেদের ব্যবসায়িক ফায়দা উঠাতে চাচ্ছে।

একটু পিছনে ফিরি। ধারণা করি, অনেকে করোনা উছিলায় গরীব মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে নিজেসহ স্ত্রী, সন্তানকে পিপিই পড়িয়ে চাল ডাল বিতরণ করবে। আর সন্তানকে আগামীর জন্য প্রস্তুতি নিতে বলবে- এসব প্রজাদের কিভাবে দান করতে হয়! আর তথাকথিত সন্তানও খুব মজা পাবে আর শিখবে কিভাবে সাধারণে দান করতে হয়!

ভয়ও হয়, আল্লাহ আমাদের যদি কোনদিন দান গ্রহীতার কাতারে নামিয়ে আনেন? আল্লাহ ইচ্ছে করলে সবই পারেন। ভাবছি, সেই সময়ে আমাদেরও কী একই অপমান সহ্য করে দান গ্রহণ করতে হবে? কিছুই করার নেই। বিপদে পড়লেই মানুষ দানের লাইনে দাঁড়ায়। এটিকে পুঁজি করে কারও সস্তা জনপ্রিয়তার চেষ্টা কাম্য নয়।

যেটি বলছিলাম, কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে চেহারাটা দেখিয়ে দান নিতে হবে! কারণ আমার ঘরে স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবা সবাই না খেয়ে আছে! কে বুঝবে আমাদের সেই কষ্ট? কোথাও কেউ নেই সেই কষ্ট উপলব্ধি করার। আর কেউ বুঝবেই কেন? দানের একই কাজ তো কয়দিন আগে আমিও করেছি। আমিও হয়তো লোক দেখানো দানবীর সেজেছি। প্রতিদান হিসেবে আজকে আল্লাহ আমাকেই লাইনে দাঁড়ি করিয়ে দিয়েছেন!

লেখক-
মো. জামাল হোসেন
সম্পাদক
দৈনিক আনন্দবাজার

সংবাদটি শেয়ার করুন