শেখ হাসিনার শাসনামলে ঢাকা-দিল্লির বন্ধুত্বের ‘প্রসাধনী প্রলেপ’ তার পতনের পর ধুয়ে গিয়ে দুদেশের সীমান্তে আগের ক্ষতগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কারণে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনসহ পরিখা খনন করেছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী অনেক বাসিন্দা দেশীয় অস্ত্র হাতে বিজিবির পাশে দাঁড়িয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে উত্তেজনা
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে তিন দিন ধরে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। বুধবার সন্ধ্যায় সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ের পতাকা বৈঠকের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও স্থানীয়দের উৎকণ্ঠা কাটেনি। কয়েক দফা পতাকা বৈঠক শেষে ভারতের মাহদীপুরে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে আরেকটি বৈঠক হওয়ার পর দুই দেশই অতিরিক্ত জওয়ান সরিয়ে নিলেও বাংকার ও নির্মাণসামগ্রীর কিছু অংশ রয়ে গেছে।
জানা গেছে, চৌকা সীমান্তের ওপারে নো ম্যানস ল্যান্ডের ১০০ গজের মধ্যে ভারত একটি কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করেছে এবং ৫ জানুয়ারি থেকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিজিবির বাধা সত্ত্বেও বিএসএফ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কাজ চালিয়ে গেলে উভয় পক্ষ অতিরিক্ত জওয়ান মোতায়েন করে। পরে উভয় দেশের নাগরিকরাও সীমান্তে জড়ো হয়ে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।
বিজিবি-রাজশাহী সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল ইমরান ইবনে রউফ বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ১৫০ গজের ভেতরে স্থাপনা তৈরিতে আপত্তি জানালে বিএসএফ অস্থায়ীভাবে কাজ বন্ধ করেছে।
লালমনিরহাট ও নওগাঁ সীমান্তে একই রকম ঘটনা
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ধবলসূতী সীমান্তে গত মঙ্গলবার বিএসএফ শূন্যরেখা বরাবর লাইটপোস্ট বসানোর চেষ্টা করলে বিজিবির প্রতিবাদে তারা পিছু হটে। একইভাবে ১ জানুয়ারি দহগ্রাম ইউনিয়নের সরকারপাড়া সীমান্তেও কাঁটাতারের বেড়া ও লাইটপোস্ট স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার বস্তাবর সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় বুধবার থেকে সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আজ শুক্রবার উভয় পক্ষের মধ্যে পতাকা বৈঠক হওয়ার কথা।
সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি
শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ থাকা সত্ত্বেও বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি। সর্বশেষ গত বুধবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ সীমান্তে সাইদুল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। সুনামগঞ্জ-২৮ বিজিবির অধিনায়ক জাকারিয়া কাদির জানিয়েছেন, ভারতীয় ভূখণ্ডের ২০ গজ ভেতরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় সাইদুলের সঙ্গে আরও পাঁচ-ছয়জন ছিলেন, যারা দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন।
আগের সরকারের সময় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড রোধে বাংলাদেশ তেমন জোরালো ভূমিকা রাখেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তবু সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সীমান্তে “পিঠ নয়, বুক দেখানোর” নির্দেশ দিয়েছেন বিজিবিকে।
বিএসএফের প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় বিএসএফ সীমান্তে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিচ্ছে। বাহিনীর দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি নীলোৎপল কুমার পাণ্ডে জানিয়েছেন, নাইট ভিশন ক্যামেরা, প্যান-টিল্ট-জুম ক্যামেরা ও সেন্সরযুক্ত বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে কন্ট্রোল রুম থেকে সরাসরি নজরদারি করা হচ্ছে। ট্রিপ-লেয়ার ফ্লেয়ার ও সেন্সরের ব্যবহারেও সাফল্য আসছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।