আমার কিছু বলার আছে! পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি প্রায় এক মাস হয়ে এলো। ৪ আগস্ট বিকেলে ঢাকার বাসা থেকে যখন বিমানবন্দরের পথে রওনা হই, দেশ তখন অগ্নিগর্ভ। আমি সামান্য মানুষ, দেশের কী হবে তা নিয়ে চিন্তা কম ছিলো। বরং শিক্ষার্থীদের পক্ষে আওয়াজ তোলা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী শিক্ষক ও আমার আরেক কর্মস্থল যমুনা টেলিভিশনের সহকর্মী সংবাদকর্মীদের কী পরিণতি হবে-তা নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলাম, রীতিমতো চোখের পানি ঝরছিলো।
আটলান্টিকের ওপর উড়োজাহাজের নিউজ ফিডে যখন সরকার পতনের খবর পাই, তখন কিছুটা শান্ত হয় মন। কিন্তু বর্তমান যুগের মূল যে আদালত, সেই ফেসবুকে এই ‘শান্তি’ নিয়ে কিছু না লেখায় বন্ধুমহলের অনেকেই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বসিয়েছেন। কেন বিগত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কিছু লিখছি না-এমন অনুযোগও আসছে। লিখতে যে চাইনি তা নয়, কিন্তু ‘বিদেশে গিয়ে এমন বড় বড় কথা বলা যায়’ কিংবা ‘বিদেশ গিয়েই ভোল পাল্টে যায়’-এমন অপবাদের ভয়ে কিবোর্ডে হাত চলেনি।
রাজপথে রক্তের দাগ শুকায়নি, আহতদের মৃত্যুর মিছিল থামেনি-এমন সময়ে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, অনুভূতির কথা বলতেও বাধা দিচ্ছে বিবেক। কিছু কথা বলাও অবশ্য জরুরি। ব্যক্তিপর্যায়ের এই ছোট ছোট ঘটনাগুলোই যেন দলিল হয়ে থাকে ইতিহাসের।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ২০০২-০৩ সেশনে। আমার বাবা-মা দুজনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট, আমার নানা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন ভারত ভাগেরও আগে। তাই ছাত্র খারাপ হলেও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো-একেবারে ছোটবেলা থেকে বিশ্বাস ছিলো মনে।
ভর্তি পরীক্ষায় সিরিয়াল খারাপ ছিলো না। সুযোগ ছিলো বেশ অনেকগুলো বিষয় বেছে নেওয়ার। কিন্তু নটরডেম কলেজে পড়ার সময়ই বাসে দেখা হওয়া এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে মনে মনে ছিলো, সাংবাদিকতা পড়বো। বিভাগের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রথম বর্ষ থেকেই যুক্ত হই সাংবাদিকতায়। আমার মাত্র ৪০ বছরের জীবনে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাই তাই ২১ বছরের। এতো সম্মান ও ভালোবাসা এই পেশায় পেয়েছি, সারাজীবন শুকরিয়া আদায় করলেও তার প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়। পথে বাধা আসেনি, তা নয়।
কখনো শিবির, কখনো ছাত্রদল ট্যাগ দিয়ে কাবু করা হয়েছে, দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, চাকরি হুমকির মুখে পড়েছে। অসাধারণ কিছু বড় ভাই পাশে ছিলেন বলে সসম্মানেই চাকরি করতে পেরেছি। বলতে দ্বিধা নেই, কর্মক্ষেত্রে বাড়তি দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে না পারলে হয়তো ভেসেই যেতে হতো। নানা ‘ট্যাগ’ ছিলো বলে অন্য সহকর্মীদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছি, দিনরাত খেটেছি।
কঠোর পরিশ্রম করার এই সামর্থ্যই হয়তো ছাত্রজীবনে ফলাফল ভালো করতে সহায়তা করেছে আমাকে। নটরডেম কলেজে প্রথম বর্ষের ফাইনালে পুরো মানবিক শাখায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম। প্রথম বর্ষ থেকে সবেতনে চাকরি করেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্স-দুই পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে গেলাম। স্বর্ণপদক পেলাম বেশ কয়েকটা।
শিক্ষকদের সম্মান করতাম, তাদের সাথে সুসম্পর্ক ছিলো-এটা ঠিক। কিন্তু আমার শত্রুও বলতে পারবে না শিক্ষকদের ব্যাগ টেনে বা ফরমায়েশ খেটে প্রথম হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো, ছোটবেলা থেকে সেই স্বপ্ন থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো-তেমন স্বপ্ন ছিলো না। কিন্তু ফলাফল আমাকে লোভী ও উচ্চাকাঙ্খী করে তুললো। বিভাগে আমার আগে বেশ কয়েক বছর ‘ডাবল ফার্স্ট’ ছিলো না। তাই আশাবাদী হয়ে উঠলাম।
শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হলো। আবেদন করলাম; ভাইভা দিলাম, চাকরি হলো না। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার অপরাধ অনেকগুলো: ১. আমি বিএনপি-ঘেষা ইনকিলাব পত্রিকায় চাকরি করেছি; ২. আমি মাধ্যমিকে মাদ্রাসায় পড়েছি; ৩. আমার পরিবার ডানপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত। আমার জীবনে আমি মাদ্রাসায় পড়েছি ৪ বছর, সেটাও পরিবারের সিদ্ধান্তে, পরে নটরডেমের মতো দেশসেরা কলেজে পড়েও, স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাবল ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েও সে ’অপরাধ’ ঘোচানো গেলো না।
যা-ই হোক, আমি নাছোড়বান্দা। বেশ কয়েকটা ভাইভা দিলাম ও যথারীতি ‘ফেইল’ করতে থাকলাম। যাদের নিয়োগ হলো, কারো রেজাল্টই আমার চেয়ে ভালো নয়, এমনকি কাছাকাছিও নয়। আমার স্ত্রী, যিনি আমার সহপাঠীও বটে, সন্দেহ করতে লাগলেন আমি বুঝি ভাইভায় কোনো উত্তর দিতে পারি না। মনে আছে, তার সন্দেহ দূর করতে একটা ২৮ মিনিটের ভাইভা মোবাইল ফোনে রেকর্ডও করে এনেছিলাম। যা-ই হোক, এক পর্যায়ে আমি বুঝে গেলাম যে ভয়াবহ ‘অপরাধে’ আমি অপরাধী, তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরি হবে না।
মেনে নিলেও মন মানতে চাইতো না। ‘টেলিভিশন এন্ড ফিল্ম স্টাডিজ’ নামে নতুন একটি বিভাগ চালু হচ্ছে। একসাথে ৩ জন নতুন প্রভাষক নিয়োগ হবে। একদিকে আমার রেজাল্ট ‘বেশ ভালো’, অপরদিকে টেলিভিশনে লম্বা সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা। ঘনিষ্ঠজনরা বললেন, তুমিই সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী। তাদের কথায় মজেই আবেদন করলাম।
নতুন বিভাগের চেয়ারম্যানকে চিনতাম না, তবু একদিন দেখা করলাম। আরেফিন স্যার, আমার সরাসরি শিক্ষক তখনকার ভিসি, তার সাথেও দেখা করলাম। সাংবাদিক হিসেবে পরিচয়ের সূত্রে দেখা করলাম, সিন্ডিকেট সদস্য তাজমেরী ম্যাডামের সঙ্গে। তবে মনে মনে মেনেই নিয়েছিলাম চাকরি হবে না। ভাইভার তারিখ একবার পরিবর্তন করে সিন্ডিকেট সভার ঠিক আগমুহুর্তে বোর্ড বসলো। রাতে বাসায় ফিরে কয়েকজনের ফোন পেলাম, আমার নাকি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ হয়েছে।
সিন্ডিকেটে নাকি পাসও হয়ে গেছে। আমি কিছুই জানি না, কিন্তু অভিনন্দন বার্তা পেতে থাকলাম। অজানা এক অনুভূতিতে রাতে ঘুম হলো না। সকালে বিভাগের চেয়ারম্যানকে ফোন দিলাম। তিনিও অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, সেদিনই জয়েন করতে। ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট পরে ফুলবাবু সেজে বিভাগে গেলাম। অল্প টাকা বেতন তখন, তবু সিএনজি নিলাম। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। বিভাগে গিয়ে অফিসরুমে উঁকি দিলে সেখানকার কর্মকর্তা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলেন। ভাবলাম, অবশেষে বাবা-মা আর নানার পেশায় এলাম, ‘স্যার’ হয়েই গেলাম। বিভাগে চেয়ারম্যান উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। জানালেন, কতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাকে নিয়েছেন। মিষ্টি খাওয়ালেন। বাকি ৩ নবনিযুক্ত সহকর্মীর সাথে পরিচয় করালেন। শিক্ষক লাউঞ্জে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করালেন।
ডিনের অফিসে (ফরিদ স্যার তখন ডিন) নিয়ে গিয়ে ডিনের সাথে পরিচয় করালেন। ডিন প্রত্যেকের আলাদা ছবি তুলে মোবাইলে নম্বর সেইভ করলেন। সামনেই ভর্তি পরীক্ষা ছিলো, পরীক্ষার ডিউটি দেওয়ার জন্য অফিসের সহকারীকে নির্দেশ দিলেন। বেশ ফুরফুরে মনে ছিলাম। দুপুরের পর চেয়ারম্যান একত্রে আমাদের ৪ জনকে যোগদানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে যেতে বললেন। ৪ জন একত্রে গেলাম, ৩ জনের যোগদান হলো। আমারটা হলো না। সিন্ডিকেটে পাস হওয়া নথিতে লেখা ছিলো, ‘বিভাগের সিএন্ডডির অনুমোদন সাপেক্ষে ইব্রাহীম বিন হারুনকে নিয়োগ দেওয়া হলো’। কর্মকর্তারা বললেন, ’এটা কোনো বিষয়ই না। যেহেতু বিজ্ঞপ্তি ছিলো ৩ জন নিয়োগের। অতিরিক্ত একজন নেওয়ার জন্য সিএন্ডডির অনুমোদন সাধারণ ফরমালিটি। আর নতুন বিভাগগুলো অতিরিক্ত পদ চেয়েও পায় না, আপনার তো সিন্ডিকেট থেকেই দিয়েছে। নাকচ করার সুযোগই নেই ‘।
গেলাম চেয়ারম্যানের কাছে। মনে হলো তিনি জানেনই না বিষয়টা। নিয়ে গেলেন ডিনের কাছে। ডিন বললেন, ‘আজ-কালের মধ্যেই হয়ে যাবে। সিএন্ডডির সদস্য আমরা ৩ জন। এর মধ্যে দুজন তো বোর্ডেই ছিলাম। তার মানে এটা পাস হওয়াই। শুধু একত্রে বসে একটা নথি পাঠাতে হবে।’ তখনও বুঝিনি কত বড় ধাক্কা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
লং স্টোরি শর্ট: পরে আরো ৩/৪ দিন বিভাগে গিয়ে বসে থাকলাম। হবে, হচ্ছে করেও গত ১৩ বছরে সেই সিএন্ডডি বৈঠক আর হলো না। ‘অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তোমাকে নিয়েছি’ বলা চেয়ারম্যানের আচরণও দেখলাম বদলে যাচ্ছে। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ভিসির পা ধরতে। রিজিকের মালিক আল্লাহ-এটা বিশ্বাস করি বলে সে পথে পা বাড়াইনি।
আমার প্রশ্ন, সিন্ডিকেটের সুপারিশের পরও একজন অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগে যে সিএন্ডডি আপত্তি জানালো পরবর্তীতে ওই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ হলে আগের সুপারিশকৃত ব্যক্তিই কেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়োগ পাবেন না? কিন্তু এই প্রশ্ন আমি কারো কাছে তুলিনি। এই পোস্টের উদ্দেশ্যও সেটা নয়। আমি শুধু একটি নির্মমতার কথা তুলে ধরতে চাই, আপনি চাকরি দিবেন না-ভালো কথা। কিন্তু, চাকরির আশা জাগিয়ে, খবর ছড়িয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা উচিত নয়। শিক্ষক লাউঞ্জের মিষ্টি, ডিন অফিসের অভ্যর্থনা, ভর্তি পরীক্ষার ডিউটিতে নাম তোলা-এগুলো তো চরম নিরাশ মানুষের মনেও আশার বাতি জ্বেলেছিল। আমি স্ত্রী-পরিবার ছাড়া কাউকে বলিনি আমার চাকরি হয়েছে। তবু দুনিয়ার মানুষ আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলো, আমার বন্ধুদের গ্রুপে হাসাহাসি হলো-একজন তরুণকে যে মানসিক কষ্ট দিলো, অপমানিত করলো তা বর্ণনাতীত।
ওই ঘটনার পরও অন্তত ৩ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের সময় ভোট চেয়ে এসএমএস পেতাম। চাকরি দেওয়ার খবরেই প্রার্থীরা হয়তো নম্বর যোগাড় করেছিলেন, যোগদান যে করতে দেওয়া হয়নি, সেই খবরও রাখেননি। কতিপয় শিক্ষকের প্রতি সেই যে ক্ষোভের জন্ম হলো, তা ১০ বছরের বেশি সময় আর বিভাগে যেতে দেয়নি। সেই যে মাথা নত হলো, কোমড় ভেঙে দেওয়া হলো, জগন্নাথে যোগ দিয়ে এমন নীরব থাকতে লাগলাম যে নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান হতাম মাঝেমধ্যে। নতুন জয়েন করেছি জেনে ৬/৭ বছরের জুনিয়রও (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় সিনিয়র) ‘তুমি’, ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে, কিছু বলার প্রয়োজনও মনে করিনি।
- সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়