স্বাধীনতার জন্য শতবার বিপ্লব হলেও এদেশের জনগণ কখনোই স্বাধীনতার স্বাদ পায়না। এর অন্যতম কারণ সরকারগুলো নিজেরাই পরাধীন হয়ে যায় ঔপনিবেশিক আইনের কাছে অথবা বাধ্য করা হয় আমলাতন্ত্রিক জটিলতার মাধ্যমে পরাধীন হতে। যার ফল সরকারগুলো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে স্বৈরাচার। স্বাধীনতার ৫৩ বছর ধরে তাই হয়ে আসছে। যে সরকার নিজেই পরাধীন স্বৈরাচারী আইনের কাছে সে আবার কিভাবে জনগণকে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করাবে।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
আমার মনে হয় ক্ষমতার নামক চেয়ারের সাথে একটি করে দূরবীন লাগানো থাকে, যা দিয়ে শুধু ষড়যন্ত্র টাই দেখা যায়। দেখা যায় না মানুষের ভালোবাসা, ক্ষোভ, ঘৃণা অথবা ক্ষুধা, বৈষম্য, মৌলিক অধিকারে চাওয়া-পাওয়া।
শুধু দূরবীনি নয়, আমার মনে হয় ক্ষমতার চেয়ারের সাথে একটা করে হেড ফোনও লাগানো থাকে। যা দিয়ে শুধু শোনা যায় ষড়যন্ত্রের গল্প। তবে হলফ করে বলতেই পারি এটা দিয়ে শোনা যায় না মানুষের আহাজারী, মানুষের বলা সত্য কথাগুলো।
স্বাধীনতার পর থেকে এই ধারাবাহিকতাই চলছে। যখনই কোন সরকার দায়িত্ব নেয়, তখনই অদৃশ্য এক ষড়যন্ত্রকারী ঐ ষড়যন্ত্রের দূরবীন আর হেডফোন গুলো সরকার ও সরকারভোগীদের চোখে আর কানে লাগিয়ে দেয়। আর কেউ যখন জনগণের মৌলিক অধিকার বা জনগণের সমস্যা নিয়ে লিখে তখনই ষড়যন্ত্র মাপক ঐ দূরবীন দিয়ে জনগনের জন্য লেখাগুলোকে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র বা রাষ্ট্রবিরোধী তকমা লাগিয়ে দেয়। আবার কেউ জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বললে তখনই ষড়যন্ত্র মাপক ঐ হেডফোন দিয়ে সরকারকে শুনানো হয় কোন একটা পক্ষ সরকার উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আর এরকমভাবে এই রাষ্ট্রের প্রতিটা সরকারকেই রাষ্ট্রের এক বিরাট ষড়যন্ত্রকারী জনগোষ্ঠী নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আর যখন সরকার বিপদে পড়ে তখন ষড়যন্ত্রের ঐ দূরবীন ও হেডফোনের কারিগরা নিজেদের আড়াল করে নেয়।
আরেকটু স্পষ্ট করে বলি, ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে এমনিতেই কিছু সাধারণ মানুষ ধানমণ্ডি ৩২ এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যেতো, কারও কোন নির্দেশনা ছাড়াই। কিন্ত যখনই নির্দেশপত্র আসলো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ১৫ ই আগস্টের অনুষ্ঠানের যোগদান করার জন্য, তখনই একটা মহল এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলো প্রতি বিপ্লবের বা সরকার উৎখাতের। আবার ষড়যন্ত্র থাকতেও পারে। এই ষড়যন্ত্রকারীদের আটকাতে ঘোষণা এলো ‘১৫ তারিখ সারাদিন, সারাবাংলায় মামলা দিন’। শুরু হয়ে গেলো ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগষ্ট পর্যন্ত যতগুলো হত্যাকান্ড ও হামলা হয়েছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে মামলা করা, একেকটা মামলাতে হাজার হাজার লোককে মামলার আসামী করা। আর আসবই শুধুমাত্র কল্পিত প্রতি বিপ্লব ঠেকানোর জন্য।
অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটা প্রধান দাবীই ছিলো হত্যাকান্ড গুলোর সুষ্ঠ তদন্ত করে প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পুরো উল্টা। মামলাগুলোর ধরণ দেখেই বুঝা যাচ্ছে শতভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলাগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে, হত্যাকারীদের বিচার করার জন্য নয়। কয়েকটা মামলার তথ্য বিবরণী দেখলে আঁতকে উঠবে যে কেউ কারণ মামলার এজাহারে কোন আসামী কী অপরাধ করেছে তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখও নাই। আবার প্রতিটা মামলাতেই আসামী করা হচ্ছে হাজারে হাজার।
এই হাজার হাজার আসামী কিন্ত অস্ত্রধারী ছিলো না। হয়তো পনেরো থেকে বিশ জন অস্ত্রধারী ঘাতক ছিলো, হয়তো তিরিশ থেকে চল্লিশ জন ছিলো বোমাবাজ, হয়তো এক থেকে দেড়শত জন ছিলো লাঠি নিয়ে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই মামলাগুলোতে উল্লেখ নাই কোন বিশজন ছিলো অস্ত্রধারী , কোন চল্লিশ জন ছিলো বোমাবাজ বা কোন দেড়শত জন লাঠি নিয়ে ছিলো রাজপথে। যে তদন্তকারী কর্মকর্তা এই মামলা তদন্ত করবে সে ৫০ বছরেও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারবেনা। আবার যদি গোঁজামিল করে দিয়েও দেয় আওয়ামী আমলের মত কোন ক্যাংগারু কোর্টও এই মামলার ফায়সালা দিতে পারবে না, সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে। অবশেষে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। অন্যদিকে যখন জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা হত্যাকান্ডগুলো তদন্ত করতে আসবে তারাও মামলার ধরন ও আসামীর সংখ্যা দেখে এই মামলাগুলোকে ভুয়া বলে ঘোষণা করে দিয়ে যাবে। আর এভাবেই শহীদের আত্মা সবসময় অসন্তুষ্টই থেকে যায়। আর এটাই ঔপনিবেশিকতা।
কারণ যেই ই সরকারে আসে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে আসে না, আসে জনগনকে শাসন করতে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভুল হয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমানোর নামে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ ও গুলি করা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এ গুলি করা মানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাতেই গুলি করা আর তাই আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং তারা রাস্তাতে নামা তো দুরে থাক সরকারের পক্ষে কথাই বলেনি।
আর যারা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি করেছে তারা আওয়ামী লীগের কেউ নন। কারণ কোন প্রকৃত আওয়ামী লীগার মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আঘাত করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই হলো যেকোন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা ও আন্দোলন করা, যা আওয়ামী লীগ বিগত পনেরো বছরে করেনি বা হেডফোন দূরবীন কারিগরদের জন্য করতে পারেনি। যার ফলাফল আজ আওয়ামী লীগকে ভোগ করতে হচ্ছে।
এবার দলগুলো নিয়ে লিখি। বাংলাদেশের কোন দলের ভিতরেই গণতন্ত্র নেই বললেই চলে, সবই ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতি। কোন কোন দলে চলে পরিবার তন্ত্র, সেখানে কর্মীদের মতামত দেওয়ার কোন সুযোগ নাই, আছে শুধু প্রশংসাসূচক কিছু কথা, দলগুলো জিম্মি হয়ে থাকে মহারাজ, যুবরাজ, রাজবধুদের কাছে। ভয়েও তাদের বিরুদ্ধে কেউ মতামত দিতে যায় না। যদিও কেউ দেয় তাহলে তাদের প্রশাসন দিয়ে হয়রানি করা হবে, নাহয় ব্যবসায় ক্ষতি করবে আর নাহয় তাদের নির্দিষ্ট কিছু বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে আপনাকে অপমান করা হবে। যার ফলাফল অনেকে লজ্জায় রাজনীতি টাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এই যে দেখেন একটা আওয়ামী লীগের লোককেও দেখলাম না নতুন সরকারকে শুভেচ্ছা দিতে, কিন্ত গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো পরাজয় মেনে নিয়ে অতীতের কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নেওয়া। অনেকে শুভেচ্ছা দিতে চায়, কিন্ত তারাও দিতে পারছে কারন ও-ই যে দূরবীণ ও হেডফোন তত্ত্ব।
শুভেচ্ছাদাতাকে হয় সরকারের দালাল বানাবে আর নাহয় বানাবে এ যুগের মোশতাক, ফারুক, রশিদ ……..। যতদিন দলে গণতন্ত্র আসবে না ততদিন রাষ্ট্রীয় গনতন্ত্র নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।
শুভেচ্ছা দিয়েই ইউনুস সরকার সম্পর্কে কিছু লিখতে চাই, যেহেতু এই সরকার ছাত্র ও জনতার বিপ্লবের ফসল, তাই এই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার পারদও থাকবে বেশী। এই সরকারে যারাই আছে সবাই জ্ঞানী এবং গুণী ব্যক্তি, কিন্তু কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। তাই তাদের হয়তো জনগণের পালসটা বুঝতে কষ্ট হবে আর এই সরকারের প্রধান একজন শান্তিতে নোবেল জয়ী এবং অসংখ্য পুরস্কার পাওয়া সম্মানিত ব্যক্তি তাই উনার কাছে এদেশের জনগণের চাওয়াটাও একটু বেশী থাকবে। তিনি এখন এদেশের ১৮ কোটি জনগণের অভিভাবক। অভিভাবক মানে রাষ্ট্রের জনগণের পিতা। একটি পরিবারের সব সদস্য কিন্ত এক হয় না, কেউ নম্রভদ্র হয় কেউ একরোখা হয়, কেউ হয় চোর, আর কেউ হয় নেশাগ্রস্ত। হে সন্তানের কর্মফল হিসেবে পিতা তাকে শাস্তি দিবে কিন্তু তার মানে এ-ই না সব সন্তানকে সমান ভালো ভাসবে না। পিতার সামনে এক সন্তান যদি আরেক সন্তানকে ঘর থেকে বের করে দেয় বা নির্যাতন করে পিতার দায়িত্ব দুই সন্তানকেই শান্ত করা ও শাসন করা। মাথাব্যথার ঔষধ কখনোই মাথা কেটে ফেলা নয়। ইউনুস সাহেব যদি পিতা হিসাবে দেশ পরিচালনা করতে পারেন তাহলে তিনি সফলভাবে দেশ পরিচালনায় সক্ষম হবেন, অন্যথায় বর্তমানে যে অবস্থা চলছে এই অবস্থা যদি আর কিছুদিন চলে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি উনার পতন আরও ভয়াবহ হবে।
কারণ যে জাতি মুগ্ধ এবং আবু সাঈদদের মতো বীরদের জন্য নিজের জীবন দিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলতে পারে সেই জাতি আওয়ামী লীগের কোন এক মুগ্ধ বা আবু সাঈদের জন্য নিজের জীবন দিয়ে হলেও উনার পতন ঘটাবে। এই দেশের জনগণ অনেক আবেগপ্রবণ এবং বিপ্লবী, তারা যখন তখন যেকোন কিছু করে ফেলতে পারে। এটা সত্য জনগণের অনেক ক্ষোভ এবং ঘৃণা আছে আওয়ামী লীগের উপর, কিন্তু এই ঘৃণা যে কখন মায়া আর ভালোবাসায় পরিনত হবে আপনারা টেরই পাবেননা। আওয়ামী লীগের লোকদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ব্যবসা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে এটা জাতি বেশিদিন মেনে নিবেনা।
সরকারকে কণ্ঠাগতকরণের দূরবীণ ও হেডফোন তত্ত্বের অবসান হোক আপনার মধ্য দিয়ে সরকার প্রধান হিসাবে নয় পিতা হিসাবে আপনার প্রত্যেক সন্তানকে নিজ ঘরে থাকার সুযোগ করে দিন। রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে কোন বিশেষ দলের সদস্য না মনে করে নিজের সন্তান মনে করে মৌলিক অধিকার ভোগ করার ব্যবস্থা করে দিন। দেখবেন সবাই আপনাকে সরকার প্রধান হিসেবে না পিতা হিসেবেই সম্মান করবে ও ভালোবাসবে। আমার বিশ্বাস আপনি সফল হবেন।
ব্যক্তির চেয়ে দল বড়,
দলের চেয়ে দেশ বড়
তাই সবার উচিত দেশ গঠনে এগিয়ে আসা। বাচ্চা গুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া।
শুভেচ্ছা দিয়েছি এখন অভিনন্দনটা দেওয়ার সুযোগ করে দিন।