ঢাকা | মঙ্গলবার
৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বনন্দিত কর্মসূচি কমিউনিটি ক্লিনিক

আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা আছিয়া খাতুন (১৮) চাকুরি করেন ভিশন গার্মেন্টসে। থাকেন মিরপুর-১৩ এর একটি বস্তিতে। অফিস শেষে সেদিনও আছিয়া প্রতিদিনের মতোই রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। হঠাৎ পেটে ব্যথা শুরু হলে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়েন মাটিতে। স্বামী দৌড়ে এসে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে আছিয়া বলেন মনে হয় ‘পেইন’ উঠছে। ‘তুমি আমাকে হাসপাতালে নিয়া চলো।’ হঠাৎ এ ধরনের ব্যথা উঠায় ইসহাক বুঝতে পারছিলেন না কোথায় নেবেন। পাশের ঘরের ভাবি এসে জানালেন পাশেই থাকা কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা। তার কথায় ইসহাক আছিয়ার প্রথম সন্তান হলো কমিউনিটি ক্লিনিকে।

সত্যিই প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক অনন্য মডেল হিসাবে কমিউনিটি ক্লিনিক আজ বিশ্বনন্দিত। ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশ যখন এক বিপুল জনসংখ্যার চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ার কথা, সেই সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার এই মডেলকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আসিফ ইকবাল বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে গড়ে প্রতিবছর সাড়ে সাত কোটি রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। আর দুই কোটির বেশি রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করা হয়। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগীদের বিনামূল্যে ৫৭ প্রকার ওষুধ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, স্থানীয় জনগণের জমিতে সরকারের টাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় জনগণই এই ক্লিনিক পরিচালনা করেন। এতে করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে এলাকাবাসীর মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সেবার গুণগত মান বজায় রাখতেও তারা ভূমিকা রাখেন। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দেশের গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করেছে। ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে।

ডা. আসিফ বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পিত একটি উদ্যোগ। বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে তিনি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এই অনন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করেন, যা সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুফল ভোগে বিপ্লব ঘটিয়েছে।

এমনকি কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব যখন দিশেহারা তখনও বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো স্বাস্থ্যসেবায় এক অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোভিড-১৯ এর টিকাদান কর্মসূচিকে সফল করে তুলেছে এই কমিউনিটি ক্লিনিক।

সারা দেশে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৫৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ২০০টি ক্লিনিক সেবা দিচ্ছে। অবশিষ্ট ৫৩টি ক্লিনিকে সেবাদানের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি চলছে।

মিরপুর-১৪ এলাকার কমিউনিটি ক্লিনিকে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এ ক্লিনিকে বিনামূল্যে প্রায় ৩২ ধরনের ওষুধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টি সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসবপূর্ব (প্রতিরোধ টিকাদানসহ), প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবা। এছাড়া সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা, পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সময়মতো প্রতিষেধক টিকা; যেমন- যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদিসহ কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হয়।

১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সি সন্তান ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মায়েদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন, জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে শিশুর জন্মনিবন্ধন, এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ছয় মাস পরপর প্রয়োজনীয় ভিটামিন-‘এ’ খাওয়ানো এবং রাতকানা রোগে আক্রান্ত শিশুদের খুঁজে বের করা ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডাররা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণকারীদের জটিল কেসগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবাপ্রদানপূর্বক দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করে থাকেন।

শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবা প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবার কল্যাণ সহকারীরা সপ্তাহে তিনদিন করে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসেন। কে কোনদিন বসবেন, তা স্থানীয়ভাবে ঠিক করা হয়। অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডাররা স্বাস্থ্য সহকারীদের তদারকি করে থাকেন।

যেসব গর্ভবতী মহিলা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রসবপূর্বক ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। এছাড়া যেসব নারী-পুরুষ ইপিআই, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা গ্রহণ করেননি, তাঁদেরও এই সেবাব্যবস্থায় নিয়ে আসা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম সফল, শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রেফারেল সেন্টার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা মরিয়ম ও তাঁর সঙ্গে আসা বিনা উভয়েই বললেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামের একেবারে উপায়হীন একজন নারীকে সন্তান প্রসবের জন্য প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের বিপদ ও অদক্ষ দাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করছে। কিছু সমস্যা থাকলেও কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কারও কোনো দ্বিমত নেই। শুধু মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় বা ধাত্রী সেবাই শুধু নয়-এসব কমিউনিটি ক্লিনিক শিশুদের টিকাদানসহ আরও অনেক সেবা দিয়ে থাকে।

আমাদের আশা কমিউনিটি ক্লিনিকের এমন কাঠামো থাকবে, যাতে এটি কোনো দিন শেষ না হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের এসব সেবার কারণে আমাদের মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন