ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যাংকিং খাতে অনাদায়ি ঋণ ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংকিং খাতে অনাদায়ি ঋণ ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজার ৭১৫ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে পুনঃ তফসিল ঋণসহ খারাপ ঋণ যোগ করা হলে তার পরিমাণ ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা দাঁড়াবে।

এদিকে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে অনাদায়ি আছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার ঋণ। সেগুলো যোগ করলে মোট অনাদায়ি ও মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাজধানীতে ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সামনে কী অপেক্ষা করছে’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

সিপিডি’র এ নির্বাহী পরিচালক খেলাপি ও বিভিন্নভাবে অনাদায়ি ঋণের বিস্তারিত তথ্য তথ্য তুলে ধরেন। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। এই আকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগ ও সাধারণ মানুষের লেনদেনের জন্য আর্থিক খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ব্যাংকিং খাতের প্রসার ঘটেছে। আমরা শুধু ব্যাংকিং খাত নিয়ে আলোচনা করি, নন-ব্যাংকিং খাতেরও সমস্যা কম নয়। ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের অন্যতম মূল নিয়ামক হচ্ছে খেলাপি ঋণ। সেটার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। এ খাতে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অনেকখানি ক্ষরণ ঘটেছে। সেই ক্ষরণের কারণে ব্যাংকিং খাত এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং পারফর্মেন্স বিষয়টি বিদেশিরা পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তারা সময় সময় এ বিষয়ে র‍্যাটিং করে থাকে উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সর্বশেষ বি-১ র‍্যাটিং এর থেকে বিদেশিরা তাদের আউটলুক র‍্যাটিং আরও কমিয়ে দিয়েছে। ব্যাংক বাই ব্যাংক হিসাব করে দেখা গেছে ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৪২ হাজার ৭১৫ কোটি থেকে বেড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা হয়েছে। এর বাইরে অনেক ধরনের দুর্বল বিষয় রয়েছে।

জানা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, পুনঃ তফসিল ঋণসহ খারাপ ঋণ যদি যোগ করা হয় তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। যা অনেক বড় অঙ্ক। এছাড়া আরও খারাপ ঋণ রয়েছে। বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যেখানে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। মোট অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও বাড়ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে যে আইনি কাঠামো দরকার, সেটা বাংলাদেশে নেই। ঋণ খেলাপের মামলাগুলো সহজে নিষ্পত্তি হচ্ছে না, যথেষ্ট বিচারক নেই সেখানে।

ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে উল্লেখ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি আমরা দেখতে পারছি না। বাংলাদেশে ব্যাংকের বাইরেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং ডিভিশনের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা, সেটা পারছে না। ব্যাংকগুলোর সমস্ত তথ্য জনসন্মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। যারা প্রকাশ করে না, তারা লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না। যতটুকু প্রকাশিত হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে তথ্যের দরজা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা তথ্যের জন্য মিডিয়ার ওপরে নির্ভর করতাম, সেটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তথ্যের অভাবের কারণে ভুল নীতি গৃহীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতকে এই অবস্থা থেকে যদি টেনে তুলতে হয়ে, তাহলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিগত দিনে আমরা দেখেছি লাভের ব্যক্তিকরণ এবং ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে বলে জানান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান।

এছাড়াও দেশের দুর্বল ও সবল ব্যাংক একীভূতকরণ প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, সরকারি ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার থেকে বহুবার অর্থ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে বার বার দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেটা রক্ষা হয়নি। এরূপ অবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যদি নিতেই হয়, তাহলে পৃথিবীর স্বনামধন্য এ্যাসেসমেন্ট কোম্পানিকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়ে আসুন। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকিং স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিলে তারা আগ্রহী হবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। আর মার্জ করার বিষয়ে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না দেখা দরকার। সবার আগে দুর্বল ব্যাংকের স্বাস্থ্য অডিটের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা দরকার, সেটা আসলে কতখানি খারাপ। তারপর ভালো ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেবে ওই ব্যাংক কিনবে কি না।

সংবাদটি শেয়ার করুন