দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি সমস্যার মধ্যে দুর্নীতিকে ১ নম্বর সমস্যা বলে মনে করেন প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় স্থানে আছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র। প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী এটি মনে করেন।
আর ব্যবসা-বাণিজ্যে তৃতীয় বড় সমস্যা হলো বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা। ৪৬ শতাংশ ব্যবসায়ীর এমনটাই ধারণা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত এক উদ্যোক্তা জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে বুধবার (১৭ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২৩’ শীর্ষক উদ্যোক্তা জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে।
২০২৩ সালে ব্যবসায় পরিবেশ কেমন ছিল, তা বিশ্লেষণ করার জন্য গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত জরিপটি করা হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সঙ্গে যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করে সিপিডি। সংবাদ সম্মেলনে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের সেবা, শিল্প, কৃষি এবং উৎপাদন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭১ জন এই জরিপে অংশ নেন। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ২৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, মাঝারি ব্যবসায়ী ৩৫ দশমিক ২১ এবং বড় ব্যবসায়ী ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ। সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, দেশের করকাঠামো পরিবেশবান্ধব নয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। একজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তিনি একটি পরিষেবা সংযোগ নিতে আবেদন করলে তাঁর কাছে যে পরিমাণ ঘুষ চাওয়া হয়েছিল, তা তাঁর পরিকল্পিত বিনিয়োগের সমপরিমাণ। বড় ব্যবসায়ীরা কোনো না কোনোভাবে ঘুষ-দুর্নীতি সামলে নিতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে এটি বড় সমস্যা।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি সমস্যা চিহ্নিত করেছে সিপিডি। প্রথম তিনটি ছাড়া অন্য সমস্যাগুলো হলো—অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, জটিল করনীতি, বারবার নীতি পরিবর্তন, দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব, উদ্ভাবনের সক্ষমতায় ঘাটতি, শ্রমশক্তিতে দুর্বল নৈতিকতা, উচ্চ করহার, জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অস্থিতিশীলতা, অপরাধ ও চুরি, বিধিনিষেধমূলক শ্রম আইন ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ১৭টি সমস্যার কথা বলা হয়েছে, তা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য। কোনো দেশে এসব সমস্যার মাত্রা ভিন্ন।
অর্থ পাচার একটা ব্যাপক স্তরে রয়েছে। অর্থ পাচার ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, এখনো ২৩ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে পুরোনো চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এবার নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। এসব কারণে ব্যবসায় পরিবেশ আরও জটিল হয়েছে। কিছু ব্যবসায়ীর সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এ সংখ্যা খুবই কম। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে বৈষম্য বাড়বে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়বে। ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক শীর্ষ পর্যায়ে সদিচ্ছার প্রতিফলন আছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও অঙ্গীকার করা হয়েছে। এর বাস্তবায়ন দরকার। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করতে ভারতের আধার কার্ডের মতো কার্ডের মাধ্যমে সমন্বিত লেনদেন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে বলেও তিনি মত দেন।
এছাড়াও, জরিপে অংশ নেওয়া ৪৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, ক্যাপাসিটি চার্জ তুলে দিলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ থাকবে না। এছাড়াও, জরিপে অংশ নেওয়া ৬৬ দশমিক ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন, আগামী দুই বছর জ্বালানি সংকটে ভুগবেন তাঁরা।
এ সম্মেলনে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি করতে সিপিডি ১০টি সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতিতে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের ১০০ দিন, ১ বছর, ৩ বছর ও ৫ বছরের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ন্যায়পাল কার্যালয় স্থাপন; সীমিত সময়ের জন্য খাতভিত্তিক কিছু কমিশন গঠন; যেমন ব্যাংক, শেয়ারবাজার, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার; একটি সমন্বিত আর্থিক লেনদেন খাত প্রতিষ্ঠা; সরকারি কেনাকাটা ব্যবস্থা আধুনিক করা ইত্যাদি।