ঢাকা | রবিবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষ নগর এলাকায় বসবাস করে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই হার ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন নিশ্চিতে কাজ করে নগর। নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি শহরের সব থেকে গুরুত্ব¡পূর্ণ সম্পদ। শহরগুলোয় বসবাসকারী ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন লোকের বেশির ভাগই পর্যাপ্ত বাসস্থান এবং পরিবহণ, স্যানিটেশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়ুর গুণমান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাগুলো মেনে চলতে ব্যর্থ হয়। এর সঙ্গে আছে দূষণের অন্যান্য রূপ, যেমন: শব্দ, পানি ও মাটি দূষণ; মাত্রাতিরিক্ত তাপনির্গমন, হাঁটা বা সাইকেল চালানো এবং সক্রিয় জীবনযাপনের জন্য জায়গার অভাব, যা শহরগুলোকে একটি অসংক্রামক রোগের মহামারির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। শহরের ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে। যেখানে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে। শহুরে এলাকার ৯১ শতাংশ মানুষ দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়। অস্বাস্থ্যকর, প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা শহুরে জনগণের মধ্যে বেশি। নগরবাসী পরিবহণ, রান্না প্রভৃতির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে; যে কারণে ৬০ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়। এ কারণে আশপাশের গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগরবাসী বেশি তাপমাত্রা অনুভব করে। এসব নগরবাসীর স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কারণে এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু ও ডায়রিয়ার মতো সংক্রামক রোগ হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, হাঁপানি, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা প্রভৃতি অসংক্রামক রোগ, সহিংসতা ও আঘাত, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা রোগের তিনগুণ স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয় শহরবাসী।

শহুরে এলাকায় কিছু পরিষেবা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সেবা প্রদানকারীর মাধ্যমেও পরিচালিত হয়ে থাকে। যদিও স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে, গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো মূলত উপজেলা স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা স্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহের তিনটি নিম্নস্তরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩১৬টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টার এবং উপজেলা পর্যায়ে ৪২৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোই পাবলিক সেক্টরের পরিষেবা সরবরাহের ৩১ শতাংশ করে থাকে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় একটি শক্তিশালী সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা রয়েছে, তবে শহরাঞ্চলে অনুরূপ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অভাব রয়েছে। শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে। সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ বিবেচনা করে, বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ শহুরে স্থানীয় সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে অংশীদারত্বের মাধ্যমে এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় শহুরে জনগণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মোট ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ১৪টি পৌরসভার ১৭ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে সেবা দেওয়া হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দরিদ্রদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা বিধান (অন্তত ৩০ শতাংশ পরিষেবা বিনামূল্যে), স্থানীয় সরকার ও সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা, রোগীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সহজ এবং কম খরচে কৈশোর কাউন্সেলিংয়ের জন্য কিশোর কোণ, স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিষেবা, কম খরচে মানুষের জরুরি স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই প্রকল্প তৈরি হয়।

জেলা হাসপাতাল বা সাধারণ হাসপাতাল প্রাথমিক স্তরের রেফারেল কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিশেষ রোগ যেমন: কার্ডিয়াক, নিউরোসায়েন্সসহ মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। বিভিন্ন ধরনের তৃতীয় স্তরের হাসপাতাল যেমন: মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদানে সহায়তা দেয়। সারা দেশে ৬২টি জেলা হাসপাতাল রয়েছে এবং প্রতিটি জেলায় রাজশাহী ও ঢাকা ছাড়া অন্তত একটি করে হাসপাতাল রয়েছে। কিছু জেলায় হাসপাতালগুলোকে বলা হয় ‘জেনারেল হাসপাতাল’ বা ‘২৫০ শয্যার হাসপাতাল’। জেলা হাসপাতালগুলো বহির্বিভাগ, আন্তবিভাগ (বহিরাগত রোগী এবং ইনপেশেন্ট পরিষেবা), এবং ইমারজেন্সি বিভাগগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক যত্ন প্রদান করে। পরবর্তী পর্যায়ে ১৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ১১টি বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। যেখানে মাধ্যমিক স্তরের রেফারেল রোগীসহ অন্যান্য রোগীদের সেবা দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৬৩ শতাংশ চিকিৎসা বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে সেবা দিচ্ছে। একদিকে যেমন তারকাবিশিষ্ট বিলাসবহুল হাসপাতাল রয়েছে, তেমনই রয়েছে নিম্নমানের ক্লিনিক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তিন ধরনের। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাবসায়িক হাসপাতাল বা ক্লিনিক, বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং দেশি বা বিদেশি এনজিও চালিত প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানই বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এ মুহূর্তে দেশে প্রায় ১৭ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে।

নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ বস্তিতে থাকে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের বক্তব্য উদ্ধৃত করে যুগান্তর জানিয়েছে, রাজধানীর বস্তিতে সাড়ে ৬ লাখ মানুষ বসবাস করেন। মন্ত্রী জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মোট বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৯টি। মোট খানা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪০টি এবং এসব বস্তিতে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন মানুষ বসবাস করেন। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ হাজার ৭৫৫টি বস্তিতে খানার সংখ্যা ৪০ হাজার ৫৯১টি এবং জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন। এসব তথ্য মন্ত্রী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা জরিপ’ ২০১৪ থেকে উল্লেখ করেছেন বলে জানান। এই মানুষগুলোর সাধারণ অসুস্থতায় চিকিৎসা পরামর্শের জন্য বাসস্থানের আশপাশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র নেই, থাকলেও তার জরাজীর্ণ দশা ও প্রচারবিমুখতার কারণে তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়। যে কারণে জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় তারা ফার্মেসিতে যোগাযোগ করে এবং সেখান থেকে ওষুধ ও পরামর্শ গ্রহণ করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করে। কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নগরের স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কাজ করছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং তাদের সেবাদানকারীদের দক্ষতা ও সেবার মান বিভিন্ন মহলে প্রশ্নবিদ্ধ।

নগর কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা। পল্লি এলাকার মতো নগরেও শক্তিশালী করতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালকেও নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে আইন সংশোধন করতে হবে। প্রতিটি বস্তি এবং নিম্ন আয়ের মানুষের বাসস্থানের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র নিশ্চিত করতে হবে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে থাকতে হবে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী। স্বল্পমূল্যে সাধারণ পরীক্ষার সুযোগ থাকতে হবে। প্রতিদিন ডাক্তার থাকতে হবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বাড়াতে হবে প্রচারণা, যাতে মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালে ভিড় না করেন। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিশ্চিত হবে নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক আজকের পত্রিকা; সভাপতি, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম

সংবাদটি শেয়ার করুন