ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাহাড় গিলে খাচ্ছে ইটভাটা

পাঁচ লাখ করে এখানের ৩০টি ভাটার মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি তুলেছেন ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার মেম্বার। ওই টাকা দিয়ে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছেন। ফলে অভিযান চালানো হয় না।

-নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইটভাটা মালিক

ফাইতং ইউনিয়নে পাহাড় কেটে বন উজাড়ের খবর পেয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সেখানে অভিযান চালাবো

-হিল্লোল বিশ্বাস, পরিচালক, চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়, পরিবেশ ভবন

বান্দরবানে কোন রকম নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা। এসব ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ আর পাহাড় কেটে মাটি দিয়ে বানানো হচ্ছে ইট। এর ফলে উজার হচ্ছে বনভুমি ধংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এমনকি অধিকাংশই ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগচ্ছে শিশুদের। কোন রকম নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা।

জেলা সদরসহ সাত উপজেলায় রয়েছে ৭০টিরও বেশী ইটভাটা। এরমধ্যে শুধু লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে রয়েছে অন্তত ৩০টি ইটভাটা। পাহাড় কেটে বনাঞ্চলের পাশেই গড়ে উঠেছে বেশীর ভাগ ইটভাটা। এসব ইটভাটার কোনটিতেই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।

জালানী হিসেবে কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে বনের কাঠ আর কাঁচামাল হিসেবে জলাশয়ের মাটি ব্যবহারের কথা থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। এজন্য এস্কেভেটর দিয়ে দিন রাত কাটা হচ্ছে বড় বড় পাহাড় আর উজার হচ্ছে শত শত একর বনভূমি। ইট তৈরীতে পাহাড়ের মাটি ও বনের কাঠ ব্যবহার করায় একদিকে যেমন ধংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ তেমনি ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারাও। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ তেমনি অতিরিক্ত ইট বোঝাই ট্রাক চলাচলের কারনে নষ্ট হচ্ছে যাতায়তের সরকারী রাস্তা। ফলে ভোগান্তিতে সাধারণ জনগণ ও স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা।

পাহাড় গিলে খাচ্ছে ইটভাটা

সরেজমিনে দেখা গেছে, ফাইতং ইউনিয়নে ছোটবড় মিলিয়ে ১০টি পাহাড় রয়েছে। এই ইউনিয়নের ৩০টি স্থানে ৩২টির মতো ইটভাটা আছে। কোথাও পাহাড়ের কোলে, কোথাও কৃষিজমিতে, আবার কোথাও জনবসতি, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বনঘেঁষে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। মাটির জন্য ভাটার মালিকরা ১০-১৫টি ভেকু মেশিন (খননযন্ত্র) দিয়ে দিনে-রাতে কাটছেন পাহাড়। মাটি স্তুপ করে রাখার পর ট্রাক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। শুধু পাহাড়ের মাটি নয়, ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য সাবাড় করা হচ্ছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের গাছপালা।

ফাইতং ইউনিয়নের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাইতং এলাকার মানিকপুর অংশে ফোরবিএম, এনআরবি, ইউবিএম, ওয়াইএসবি ও থ্রিবিএম, ফাইভবিএম, এবিসি, এনআরবি ও বিবিএমসহ অন্তত ২০টি ইটভাটা রয়েছে। ফাইতংয়ের পাহাড়ি এলাকায় আরও ১২টির মতো ভাটা আছে। এক প্রকার প্রতিযোগিতা করে এসব এলাকার পাহাড়গুলো কাটছেন ভাটার মালিকরা। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এবং ওই ইউনিয়নের সাবেক সদস্য (মেম্বার) মোক্তার হোসেন। তিনি ওয়াইএসবি ইটভাটার মালিক।

স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুব আলম ও আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, গত এক বছর ধরে এখানে পাহাড় কাটা অব্যাহত আছে। আশপাশের কয়েকটি পাহাড়ের মাটি কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পাহাড়ের ৫০একরের বেশি সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেওয় হয় নি। এর মাঝে একদিন এসে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দুই-একটি ইটভাটাকে জরিমানা করে চলে যান। চলে যাওয়ার পরদিন থেকে শুরু হয় আবার পাহাড় কাটা। যা এখনও অব্যাহত আছে। তবে কোনও কোনও ভাটা মালিক পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিতে দিনে না কেটে রাতে পাহাড় কাটছে।

ফাইতং এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, দিনে-রাতে সমানে তালে চলছে পাহাড় কাটা। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে গেলে হুমকি দেওয়া হয়। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এজন্য পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। মো. ইব্রাহিম হাওলাদার বলেন, সারা বছরই পাহাড় কেটে ইটভাটায় মাটি নিচ্ছেন ভাটার মালিকরা। স্থানীয় কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের হাত-পা বেঁধে মারধর করা হয়। ফলে আমরা দেখেও কিছু বলতে পারছি না। তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইটভাটা মালিক বলেন, পাঁচ লাখ করে এখানের ৩০টি ভাটার মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি তুলেছেন ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার মেম্বার। ওই টাকা দিয়ে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছেন। ফলে অভিযান চালানো হয় না।

এ বিষয়ে ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন বলেন, আমরা এ বছর ইটভাটার অনুমোদন নিতে পারিনি। তাই ইটভাটার কার্যক্রম চালাতে পারবো কিনা জানি না। তবে ইটভাটা প্রস্তুত করে রাখতে হচ্ছে। এজন্য মাটির জোগান দিতে পাহাড়ের কিছু অংশ কাটা হয়েছে। সবাই কাটছে, তাই আমি কাটছি। কাউকে বাধা দেওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও জানেন। ৩০টি ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে টাকা তুলে পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এটা ঠিক নয়। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে কথা বলবো।

পাহাড় কেটে বন উজাড়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফাইতং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, উন্নয়নের জন্য ইটভাটার প্রয়োজন আছে। তাই বলে এক ইউনিয়নে এতগুলো ইটভাটার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তারা আমার এলাকার বড় বড় সব পাহাড় সাবাড় করে ফেলছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি ব্যবস্থা না নেন, তাহলে এখানে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কোনও পাহাড় থাকবে না। সবগুলো সমতলে পরিণত হবে।

পাহাড় কিংবা বনাঞ্চল ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না জানতে চাইলে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, ফাইতং ইউনিয়নে ইটভাটার মালিকরা পাহাড় কাটছে বলে জেনেছি। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকটি ভাটায় অভিযান চালিয়েছি। অভিযানের সময় পাহাড় কাটার প্রমাণ পেলে জরিমানা করা হয়। তবে ওই এলাকা উপজেলা সদর থেকে দূরে হওয়ায় আমরা যখন-তখন চাইলেও যেতে পারি না। তবে অবশ্যই আবারও অভিযান চালাবো আমরা।

পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পাহাড় কাটা হচ্ছে ইটভাটা মালিকদের এমন দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহমেদ, তাদের এমন দাবি মিথ্যা। আমরা আগেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি, জরিমানা করেছি। তবে তাদের সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। আমরা তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। কোনোভাবেই থামাতে পারছি না। বারবার মামলাও দিতে পারছি না। তারপরও যতটুকু পারছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ফাইতং ইউনিয়নে পাহাড় কেটে বন উজাড়ের খবর পেয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সেখানে অভিযান চালাবো আমরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন