কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় যুগ অতিবাহিত হলেও নানা বঞ্চনা এবং বিভিন্ন সংকটে কাটছে ছাত্রীদের অবস্থা। ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের জন্য নেই কোন সাধারণ কক্ষ এবং পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা।
আবার ছাত্রীদের অনেকে নিজ বাসা থেকে এসে ক্লাস করায় ক্লাস পরীক্ষার মাঝে দীর্ঘ বিরতিতে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নারী কর্মকতা ও কর্মচারীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার দপ্তরের একাডেমিক শাখার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (৭ আগস্ট ২০২৩) জানা যায়, মোট শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪৫ শতাংশ ছাত্রী। তবে ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিশেষায়িত সেবা অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হল (নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল এবং শেখ হাসিনা হল) মিলিয়ে মাত্র ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন সুবিধা রয়েছে। আবার আসন সংকট থাকায় হলের বেশকিছু সিটে দুজন করে শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। যা মোট ছাত্রীর ২৫ শতাংশ।
হল প্রভোস্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলে সিট সংখ্যা ১৯৭ টি হলেও শিক্ষার্থী থাকেন ৩০০ জন। অপরদিকে শেখ হাসিনা হলে সিট সংখ্যা ২৫৬ টি হলেও সেখানে শিক্ষার্থী থাকেন ৩৬৬ জন।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন এবং অন্যান্য অনুষদ ভবনগুলোর কোনটিতেই নেই সাধারণ কক্ষের সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ থাকলেও যেসকল ছাত্রীরা ধর্মচর্চায় আগ্রহী তাদের জন্য নেই নামাজ পড়ার নির্ধারিত কোন স্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ টি অনুষদের মধ্যে শুধু বিজ্ঞান অনুষদে মেয়েদের জন্য নামাজের কক্ষ রয়েছে। কিন্তু সেখানেও অযু করার ব্যবস্থা নেই। এমনকি প্রশাসনিক ভবনে কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্যও নামাজ আদায়ের কোনো স্থান দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ।
আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলেও তাদের জন্যেও নেই কোন ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার। ফলে নারী সদস্যদের পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক কালের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে মেয়েদের জন্য সাধারণ কক্ষ। তাছাড়া দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য সাধারণ কক্ষের সুবিধা রয়েছে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সিনিয়র নারী শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও ছাত্রীদের দুটি হলে প্রভোস্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুরুষ শিক্ষকদের। যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় ছাত্রী হলগুলোতে প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয় নারী শিক্ষকদের।
ছাত্রীদের অভিযোগ, একজন নারী প্রাধ্যক্ষের কাছে কাছে ছাত্রীরা যেভাবে সাবলীলভাবে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলতে পারেন, কোনো পুরুষ প্রাধ্যক্ষের কাছে তা বলতে পারেনা তারা।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান আল আভী বলেন, মেয়েদের জন্য বিশেষ রুম বা কমন রুম দরকার। প্রায় সময়ই দেখা যায় একটা ক্লাস শেষ হওয়ার পর পরবর্তী ক্লাসের জন্য বাহিরে বারান্দায় বা সিঁড়িতে অবস্থান করতে হয়। এটা অনেকটাই যন্ত্রণাদায়ক। আবার কিছু ছাত্রী আছে যাদের ছোট শিশু নিয়ে ক্লাসে আসতে হয়। সেক্ষেত্রে বাহিরে দাঁড়িয়ে অবস্থান করাটা কিংবা শিশুকে খাবার খাওয়ানোর জন্য হলেও একটা বিশেষ কক্ষ দরকার, যেখানে তারা নিরাপদে সকল কার্যক্রম করতে পারবে, কিছুটা সময় অবস্থান করতে পারবে। যদি শিশুদের জন্য একটি ডে-কেয়ার কক্ষ দেয়া যায়, তাহলে অনেক মা শিক্ষার্থীই উপকৃত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের নামাজ পড়ার জন্য কোনো জায়গা নেই। আলাদা রুম থাকলে এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়া লাগতো না। এই সমস্যার কথা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো সমাধান নেই।
লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কমনরুম নেই, এটা থাকাটা খুব জরুরি। লম্বা সময় ধরে ক্যাম্পাসে থাকতে হয়, এক্ষেত্রে মেয়েদের ওয়াশরুমে যাওয়া, হাইজিন মেনটেইন করা কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়াও কিছু মেয়েলি ব্যাপার আছে যেগুলোর জন্য প্রাইভেসি দরকার। সাধারণ কক্ষে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, বড় বড় মেগা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। একইরকম জরুরি ভিত্তিতে মেয়েদের সমস্যাগুলোর দিকে আলোকপাত করে সমস্যার সমাধান করা জরুরি।
ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা কার্যালয়ের পরিচালক ড. মোহা. হাবিবুর রহমান জানান, সাধারণ কক্ষ আর নামাজের কক্ষের ব্যাপারে প্রশাসনকে জানানো হয়েছে, এটি অনেক পুরনো দাবী। এ ব্যাপারে আমি উপাচার্য মহোদয়কে বলেছি, ‘তিনি বলেছেন এই মুহূর্তে আমাদের এই ক্যাপাসিটি নেই, তবে এই ব্যাপারটি সমাধানের জন্য কাজ করবো’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন বলেন, ছাত্রীদের জন্য সাধারণ কক্ষ থাকা অবশ্যই দরকার কিন্তু বর্তমান ক্যাম্পাসে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। বর্তমানে এখানে সকল সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নতুন ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সকল সুবিধাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। যখন নতুন ক্যাম্পাস চালু হবে তখন এই ক্যাম্পাস অনেকটা খালি হয়ে যাবে, তখন আমরা এখানে কমনরুমের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।