ঢাকা | রবিবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুন্দরবনে বাড়ছে পর্যটনকেন্দ্র, ‌দেখার সু‌যোগ মিলবে ‘বাঘের বা‌ড়ি’

সুন্দরবনে বাড়ছে পর্যটনকেন্দ্র, ‌দেখার সু‌যোগ মিলবে 'বাঘের বা‌ড়ি'

অপরূপ প্রাকৃ‌তিক সৌন্দ‌র্যের লীলাভূ‌মি সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ সুন্দরবনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছরই এই বনের অপার সৌন্দর্য উপভোগে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্যটক‌দের কথা বি‌বেচনা ক‌রে খুলনা রে‌ঞ্জে দু‌টিসহ নতুন চার‌টি পর্যটক কেন্দ্র গ‌ড়ে তোলা হ‌চ্ছে। এরআ‌গে খু্লনা রে‌ঞ্জে কোন পর্যটক কেন্দ্র ছিল না।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী এবং পূর্ব বনবিভাগের আওতাধীন শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা এবং চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিকে এ বছর থেকে চালু হচ্ছে আরও নতুন চারটি পর্যটনকেন্দ্র। এছাড়া সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট (নীল কমল), কলাগাছী ও কাগাদোবেকী পর্যটনকেন্দ্র র‌য়ে‌ছে।

বন বিভাগ বলছে, ২০২১ সালে ২৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ওই নতুন চারটি পর্যটনকেন্দ্রের কাজ শুরু হয়, যা এখনো চলমান। এ বছর পর্যটন মৌসুমের শুরু থেকে কালাবগী ও আন্ধারমানিক কেন্দ্র দুটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অন্য দুটির কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। তবে নতুন চারটি পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক এলাকার গহিন বনের মধ্যে ৩৫০ বছরের পুরোনো মন্দির। এখানে দেখা মেলে পুরোনো বসতির ধ্বংসাবশেষ- কোনো রকম টিকে থাকা বাড়ির দেয়াল ও ইটের স্তূপ। ওই স্থানে পর্যটক নামার অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। তবে মন্দির ভ্রমণ করা যাবে।

বনজীবীরা জানান, ওই এলাকা ‘বাঘের বাড়ি’ নামেও পরিচিত। সেখানে প্রায়ই বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন ২ লাখ ১৭ হাজার ১৬৯ জন। এর মধ্যে বিদেশী ছিলেন ২ হাজার ২৭৪ জন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্রমণ করেছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৫ জন। এর মধ্যে বিদেশী ১ হাজার ১০৩ জন। ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৯০ জন। এর মধ্যে বিদেশী ছিল ৩৯০ জন। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ায় রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনে পর্যটকের কাছ থেকে আদায়কৃত মোট রাজস্বের পরিমাণ ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

সুন্দরবন সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্বাসমূলীয় এই বন ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬ বার রূপ বদলায়। খুব ভোরে এক রূপ, দুপুরে অন্যরূপ, পড়ন্ত বিকেলে অন্যরূপ, সন্ধ্যায় অপরূপ রূপে সজ্জিত হয়। মধ্য ও গভীররাতে একরকম ও চাঁদনিরাতে মোহনীয় রূপে সজ্জিত হয়। সুন্দরবনের করমজল ও হাড়বাড়িয়া, কটকা, জামতলা, টাইগার পয়েন্ট, বাদামতলা সমুদ্রসৈকত, কচিখালী, দুবলা শুঁটকিপল্লী, হিরণপয়েন্ট, নীলকমল, দোবেকী, কলাগাছিয়া, মান্দারবাড়িয়ায় পর্যটকদের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুবিধা রয়েছে। এসব জায়গায় পর্যটকদের জন্য বনের মধ্যেই হাঁটার পথ (উডেন ট্রেইল), বন্য জীবজন্তু বিশেষকরে হরিণ, বানর ও কুমির সংরক্ষণস্থল, ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। পর্যটকরা এসব জায়গায় ঘুরতে এবং সময় কাটাতে পারেন। এছাড়া কচিখালী সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ তো রয়েছেই।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, প্রতি বছর সুন্দরব‌নের পর্যটক বাড়ছে। শীত মৌসুমে বেশি সংখ্যক পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে যান। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের অনেক জায়গাতেই এখন বনে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরা বাঘ দেখতে পাচ্ছেন।

খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, নতুন পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হবে। পর্যটকরা সুন্দরব‌নের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ম‌নোমুগ্ধকর প‌রি‌বেশ উপ‌ভোগ কর‌তে পার‌বে।

তি‌নি আরও ব‌লেন, নতুন চারটি কেন্দ্রের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। ই‌তোম‌ধ্যে দুটি কেন্দ্রে পর্যটক যাওয়া শুরু করেছে। আশা কর‌ছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই শেখেরটেক ও আলীবান্ধা কেন্দ্র দুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া যাবে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের পরিধি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতের অংশে এর ৪০ শতাংশ এলাকা পড়েছে। তবে বৃহৎ ও ঘনঅংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এটি দেশের মোট বনাঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি।

সুন্দরবন হলো জীববৈচিত্র্যের আধার। সুন্দরবনের এক হাজার ৮৭৪. বর্গকিলোমিটার জলভাগের নদ-নদী-খালে রয়েছে ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার। সুন্দরীসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড।

৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে সুন্দরবনে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণ, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, নোনা পানির কুমির, কচ্ছপ, রাজগোখরাসহ (কিং কোবরা) বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। আছে ৩১৫ প্রজাতির পাখি।
এ‌দি‌কে, ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৯ দশমিক ৪৯৬ হেক্টর বনভূমিকে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। এগুলো হচ্ছে কটকা-কচিখালী পূর্ব অভয়ারণ্য, নীলকমল দক্ষিণ অভয়ারণ্য ও পশ্চিম অভয়ারণ্য। এরপর থেকে সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যদিও ২০১৭ সালে আরও ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ দশমিক ৫৮৪ হেক্টর এলাকাকে নতুন করে অভয়ারণ্যভুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে সুন্দরবনে এখন অভয়ারণ্য এলাকা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টর।

সুন্দরবনের বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঠ, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধুসহ ১২ ধরনের খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করা হতো। ১৯৮৯ সালে আইন করে গেওয়া, গরান ছাড়া সব ধরনের গাছ কাটা বন্ধ করা হয়। ২০০৭ সালে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর গেওয়া ও গরান আহরণও বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ। বর্তমানে শুধু মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধু ও পর্যটন থেকে রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন