ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কলেজছাত্রীকে চিকিৎসকের যৌন হয়রানি

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মঙ্গলবার সকালে এক কলেজছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অভিযুক্ত চিকিৎসকের নাম দাউদুল ইসলাম। এ ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী রোগী।

জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন ভুক্তভোগী কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি ১০ দিন ধরে জ্বরসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। আউটডোরে টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ডা. দাউদুল ইসলাম তাকে বাড়তি প্রায়োরিটি দিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে নিজের কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে নানা উসিলায় তাকে প্রায় ২ ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন এবং গায়ে হাত দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করেন। শেষের দিকে ডাক্তারের ‘খারাপ প্রস্তাবে’ ওই শিক্ষার্থী কক্ষের ভেতরে চিৎকার করলে তার মাসহ অন্য লোকজন ওই চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকে পড়েন। তখন চিকিৎসক দাউদ মুখে মাস্ক লাগিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বাইরে থাকা লোকজন তাকে ধরে ফেলেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন।

এ বিষয়ে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘‘রুমে নিয়ে ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি কোন শ্রেণিতে পড়ি। পরিচয় জানালে তিনি বলেন, ‘তুমি-তো পড়াশোনা করো, তুমি আমার পাশে বসে রোগীদের প্রেশার (বিপি) লিখে দাও এবং বলো সামনের রুমে গিয়ে অপেক্ষা করুন।’ তার কথামতো আমি সহযোগিতা করতে থাকি। ডাক্তার আমাকে আনুমানিক ২ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে একই কাজ করান। এসময় কিছুক্ষণ পরপর তিনি আমার হাত ধরেন এবং ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এত নরম কেন? এত ঠান্ডা কেন?’ আমার গালে টোকা দিয়ে বলেন, ‘মাস্ক পরো।’

এক পর্যায়ে আমি চলে আসতে চাইলে তিনি আমার হাত ধরে চেয়ারে টেনে বসান এবং যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করেন। তারপর তিনি দারোয়ানকে বলেন, ‘চা আর সিঙ্গারা নিয়ে আসুন আর দরজা বন্ধ করে দিন।’ এরপর ডাক্তার আমাকে বলেন, ‘চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াও এবং আমার কোলে এসে বসো, তোমার শরীর ভালোভাবে চেকআপ করতে হবে।’ তখন আমি চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করি। এসময় আমার মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান দীপঙ্কর দাস মাকে জানান, এখানে আপনার মেয়েকে ঢোকানো হয়নি। এটা শুনে আমি আরও চিৎকার করতে থাকি। তখন ডাক্তার আমাকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। পরিস্থিতি খারাপ দেখে তিনি দারোয়ানকে দরজা খুলে দিতে বলেন এবং তাকে পালাতে সাহায্য করতে বলেন।’’

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মাহমুদুল হাসান নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমরা বাইরে ছিলাম। যে কারণে ভেতরে কী হচ্ছিল আমরা বুঝতে পারছিলাম না। তবে একটা অসুস্থ মেয়েকে ভেতরে ডেকে নিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে রুমের ভেতরে আটকে রাখা, অবশেষে ভেতর থেকে চিৎকার শুনে সাধারণ মানুষের ভেতরে ঢোকা এবং সেই চিকিৎসকের মুখে মাস্ক লাগিয়ে কৌশলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করা- এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সন্দেহের জন্ম দেয়। আমি নিজে ওই মেয়ের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ানো ছিলাম এবং ডাক্তার পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঘটনা দেখেছি। এখানে কিছু একটা ঘটেছে তা সত্য।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা ঢাকা বলেন, মেয়েটার বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর। সামনে আবার ওর পরীক্ষা। তাই আজ সকালে মেয়ের মা তাকে নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে যান। আমি সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতালের ঘটনা জানতে পারি। এরপর সেখানে গিয়ে আর চিকিৎসককে পাইনি। তবে হাসপাতাল পরিচালক বরাবর অভিযোগ দিয়ে এসেছি।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান তিনি বলেন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওই চিকিৎসক খারাপ উদ্দেশ্যে তাকে রুমে বসিয়ে রাখেন এবং বিভিন্ন ধরনের কাজে সহযোগিতা করার জন্য বলেন। এভাবে তাকে ভেতরে দুই ঘণ্টার মতো বসিয়ে রাখেন এবং সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। এ সময় মেয়ে বারবার তার মা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন বলার পরও তাকে বের হতে দেওয়া হয়নি।

খলিলুর রহমান আরও বলেন, অফিস সময়ে হাসপাতালের আউটডোরে শত-শত রোগী থাকেন। এখানে একজন রোগীর সঙ্গে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল? এটা কেন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! কারণ আউটডোরে সবসময় অনেক মানুষের উপস্থিতি থাকে। একদম অফিস টাইমে এই জায়গাটিতে ‘ধর্ষণ-চেষ্টা’র মতো কোনো ঘটনা ঘটতেই পারে না।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মেয়ের মা প্রথমে ওই ডাক্তারের কক্ষের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ বের না হওয়ায় তিনি দরজার সামনে দারোয়ানকে বারবার গিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন। এ সময় দারোয়ান তার মেয়ে ভেতরে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করছিলেন। বাধ্য হয়ে তখন মেয়ের মা কর্তব্যরত আনসার সদস্যকে দিয়ে মাইকিং করান।

তিনি বলেন, পরে ভেতর থেকে মেয়ের চিৎকার শুনে মেয়ের মাসহ আমরা সবাই সেখানে যাই। তখন ডাক্তার দারওয়ানের সহযোগিতায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর কিছু লোক তাকে ধরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করে। ঘটনা যদি সত্য না হতো তাহলে ডাক্তার মুখে মাস্ক লাগিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন না।

আমাদের পরিবারের সবার মানসিক অবস্থা এখন খুবই বিপর্যস্ত। আমার মেয়েও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে মানসিকভাবে একটা ট্রমার মধ্যে চলে গেছে। হাসপাতালের পরিচালক আশ্বাস দিয়েছেন সুষ্ঠু বিচার করবেন। আমরা সেই বিচারের অপেক্ষায় আছি।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, ঘটনার পর আজ বিকেলে অভিযোগের কাগজ নিয়ে আমি থানায় যাই। কিন্তু সেখানে রেজাউল করিম নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে মামলা না করার পরামর্শ দেন।

তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনার তো মেয়ে, মেয়েকে কোর্টে ওঠানো আর হাঁটে ওঠানো সমান কথা। যেহেতু হাসপাতাল পরিচালকের কাছে বিচার দিয়েছেন, অবশ্যই তিনি ভালো একটা বিচার করবেন। সেখানেই তার (চিকিৎসকের) বড় ধরনের একটা পানিশমেন্ট হয়ে যাবে।’ এরপর আমি বাসায় চলে আসি।

শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, আমাদের পরিবারের সবার মানসিক অবস্থা এখন খুবই বিপর্যস্ত। আমার মেয়েও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে মানসিকভাবে একটা ট্রমার মধ্যে চলে গেছে। হাসপাতালের পরিচালক আশ্বাস দিয়েছেন সুষ্ঠু বিচার করবেন। আমরা সেই বিচারের অপেক্ষায় আছি।

অভিযুক্ত চিকিৎসক দাউদুল ইসলামকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন