ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার

দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার

মানি লন্ডারিং হল অবৈধ ভাবে আয় করা অর্থ একটি বৈধ চেহারা দেওয়ার জন্য রূপান্তর করার প্রক্রিয়া। বা অবৈধ উত্স থেকে অর্জিত অর্থ বৈধ করার প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সমুদ্রবন্দর এবং ভারত ও বার্মার সাথে দীর্ঘ অরক্ষিত সীমানার কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এবং মধ্য এশিয়ার মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের একটি ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট। বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও ব্যক্তিদের মাদক পাচার, দুর্নীতি, জালিয়াতি, জাল টাকা, স্বর্ণ চোরাচালান, ব্যাংক লুটপাট, অবৈধভাবে মুনাফা, ঘুষ বাণিজ্য এবং মানব পাচার হল অবৈধ আয়ের প্রধান উৎস।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয়-সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আটটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে দ্বিতীয়-নিম্ন অবস্থান এবং ৩২টি এশিয়া-প্যাসিফিক দেশের মধ্যে চতুর্থ-নিম্ন। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দুর্নীতি বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে । জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে, বাংলাদেশে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ মোট জাতীয় আয়ের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ । বিশ্বব্যাংকের ‘ সাহায্য স্মারক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলোদেশে আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে শতকরা সাত ভাগ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় , স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে তার মাত্র ২৫ ভাগ প্রকৃতপক্ষে সংশ্লিষ্ট খাতে কাজে লাগানো হয়েছে , বাকি ৭৫ ভাগই লুটপাট হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির ৫০ শতাংশ ব্ল্যাক মানি। দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পরও সার্বিকভাবে বিচার বিভাগে দুর্নীতি বেড়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় বলছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) উদ্যাক্তাদের ৭৭.৯ ভাগকে ব্যবসা পরিচালনা করতে কোথাও না কোথাও ঘুস দিতে হয়। সরকারি দপ্তরের ঘুষ-দুর্নীতি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। কেরানি থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা অনেকেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্যের ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে অবৈধ আয়ের প্রাথমিক উৎস হলো মাদক পাচার, ঘুষ, জালিয়াতি, জাল টাকা, সোনা চোরাচালান এবং মানব পাচার। টিআইবি জানিয়েছে, ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪.৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০.৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮.৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬.৩ শতাংশ।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে ২০২১ সালে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২২ সালে বাংলাদেশীরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে জমা করেছেন ৫ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার সুইস ফ্রাঁ। এক বছরে যা প্রায় ৮২ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৯৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ কমে গেছে। ২০২২ সালে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থজমার পরিমাণে কমে ৫৫.২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৫৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক। বর্তমানে অনিশ্চয়তার কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও বিত্তবানরা সুইস ব্যাংককে নিরাপদ মনে করছেন না। আন্তর্জাতিক স্বর্গ হিসেবে পরিচিত ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড কয়েকবছর হলো কিছুটা জবাবদিহির মধ্যে এসেছে। আগে তারা অর্থের উৎস প্রকাশ করতো না। এখন তারা সুনির্দিষ্ট তথ্য না দিলেও দেশভিত্তিক আমানতের টাকার পরিমাণ প্রকাশ করছে। ২০০২ সনে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর হওয়ার পর বার্ষিক ভিত্তিতে আমানতের হিসেব দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড। এসব কারণে বাংলাদেশের দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে টাকা আমানত রাখতে উৎসাহী হচ্ছেন না। তারা বেছে নিচ্ছেন লুক্সেমবার্গ, পানামা, বৃটিশ ভার্জিন, বার্মুডা, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে। বর্তমানে সুইস ব্যাংকে আমানত রাখা আগের বছরগুলোর মতো আকর্ষণীয় নয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ন্যাথালি চুয়ার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকার কখনই সুইস ব্যাংকের কোনো অ্যাকাউন্টধারীর বিশেষ তথ্য বা ডেটা চায়নি। সুইস সরকার চায় না কোনো দুর্নীতির টাকা বা পাচার করা টাকা সুইস ব্যাংকে জমা থাকুক।

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (চিফোরএডিএস) গত বছরের মে মাসে একটি ওয়ার্কিং পেপারে প্রকাশ করা তথ্য হতে জানা যায়, মোট ৪৫৯ জন বাংলাদেশি দুবাইতে ৩১৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৯৭২টি সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। সম্পত্তি গুলোর ৬৪টি দুবাই মেরিনায় এবং ১৯টি পাম জুমেইরাতে অবস্থিত। সেখানে ১০০টি ভিলা এবং পাঁচটিরও অধিক বিল্ডিং রয়েছে যার মালিক বাংলাদেশীরা। আরএমজি রপ্তানির আড়ালেও দুবাইতে অর্থ পাচার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাক (আরএমজি) কোম্পানি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অর্থ পাচার করছে। গত দুই বছরে কিছু পোশাক প্রস্তুতকারক প্রায় ১৪৮ কোটি টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অনুসারে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৬১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির ২৫ শতাংশের সমান। ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ৭.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মিস ইনভয়েসিং হয়েছে।

এছাড়াও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউভুক্ত দেশগুলোতে বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে, আমেরিকান ব্যাংকে বিপুল পরিমাণে অবৈধ অর্থ জমা করেছে এবং সম্পত্তি ক্রয় করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ দেশগুলি মানি লন্ডারিং ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলছে, তবে তারা এখনও ঐসব বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি । ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমবেটিং ফাইন্যান্স অব টেররিজম’ নামের একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের শীর্ষ দশটি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। ২০২০ সালে ওয়াশিংটন ভিত্তিক ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই) একটি প্রতিবেদনে বলেছিল যে গড়ে ৭৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। বাংলাদেশে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিদের অর্থ পাচারের আর একটি দেশ হল মালয়েশিয়া — যেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের সুবিধা নিয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশিরা সেখানে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পায় এবং হাজার হাজার ডলার মালয়েশিয়ায় আনতে পারে। এই অর্থগুলো সাধারণত অবৈধ উপায়ে নেয়া হয়। অর্থাৎ মালয়েশিয়া মানি লন্ডারিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ সিঙ্গাপুরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার করেছিলেন। এ টাকা সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা আছে। এছাড়াও ১০ বাংলাদেশির অর্থ পাচারের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (এফআইইউ) থেকে প্রায় ১০ জন ব্যক্তি বা সংস্থার নাম পেয়েছে যাদের নাম পানামা পেপারস এবং প্যারাডাইস পেপারস ফাঁসে অর্থ পাচারকারী হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বিদেশী এফআইইউ থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিএফআইইউ গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছিল। মিডিয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে, বিএফআইইউ পানামা পেপারসে প্রকাশিত ৪৩ জন বাংলাদেশী ব্যক্তি বা সংস্থার একটি তালিকা এবং প্যারাডাইস পেপারসে প্রকাশিত ২৬ বাংলাদেশি ব্যক্তি বা সংস্থার আরেকটি তালিকা তৈরি করেছিল।

গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪,৯৬৫ মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। যা প্রতি ডলার ১১২ টাকা হিসাবে ৫৫৬০০০ কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে ৯২ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বা যে কোনো সময় সরকার পরিবর্তন হতে পারে, পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এমন আশঙ্কায় দেশ থেকে দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যক্তি টাকা পাচার করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে টাকা পাচারকারী শতাধিক ব্যক্তির নাম প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো তারা রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন। ৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি হল মার্কিন ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, মার্কিন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে), জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদন এবং মালয়েশিয়া থেকে প্রকাশিত দেশটির সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। খুবই লজ্জাজনক হলো চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ সুযোগ দিয়েছে সরকার। কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারকে বৈধতা দিতে পারেন। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় একটি টাকাও ফেরত আসেনি।

লেখকঃ কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

সংবাদটি শেয়ার করুন