ঢাকা | বুধবার
২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শরপুরে ৫০ হাজার মানুষের জীবন কাটে হাতি আতঙ্কে

শরপুরে ৫০ হাজার মানুষের জীবন কাটে হাতি আতঙ্কে

সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুরের তিনটি উপজেলা বনাঞ্চলঘেরা। এসব পাহাড়ি এলাকায় ভারত থেকে নেমে আসা শতাধিক বন্য হাতি দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছে। তাই সরকার বন্যহাতির সুরক্ষায় সেখানে অভয়ারণ্য তৈরি করে।

কিন্তু ক্রমান্বয়ে বনাঞ্চলের ভূমি স্থানীয়রা দখলে নেয়ায় সংকুচিত হতে থাকে বনের পরিসর। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে এখন লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে এখন হাতি আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, জীবিকার আর অন্য কোনো উপায় না থাকায় বনের জমিতে তারা চাষাবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

জেলা বন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়রা চলে গেছে বন্য হাতির বাড়িতে। যেখানে হাতির থাকার কথা সেখানে এখন মানুষ রাজত্ব করছে। এর জন্য হাতি আর মানুষের দ্ব›দ্ব শুরু হয়েছে। হাতি ও মানুষের এই দ্ব›দ্ব নিরসনে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বন বিভাগসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল হাতি সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করতে ভারতের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছে। একই কারণে ভারতের কর্মকর্তারাও এদেশে এসেছেন। কিন্তু লোকবলের অভাবে সেই অভিজ্ঞতা মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তারা জানান, হাতির অভয়ারণ্য এলাকায় মানুষজন বনের ভিতরে বাড়ি-ঘর তৈরি করছে। বনের গাছপালা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গল পরিস্কার করে জবরদখল করে মৌসুমভিত্তিক ফলমূল ও সবজি আবাদ করছে। এতে বন্য হাতির আবাসস্থল ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে এসেছে। এ কারণে ক্ষুদ্ধ হাতির দল লোকালয়ে এসে মানুষের বাড়ি ঘরে বারবার হানা দিচ্ছে এবং চলতি আমন ধানের পাকা ফসল খেয়ে সাবার করে দিয়েছে। বাদ যাচ্ছে না ফল বাগান আর সবজি ক্ষেত।

তারা জানান, স্থানীয় জনসাধারণের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৬ সালে লোকালয়ে হাতির হামলা ঠেকাতে ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকুচা এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফ্যান্সিংয়ের (বৈদ্যুতিক বেড়া) পাইলট প্রকল্প (পরীক্ষামূলক) বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এসব এলাকার মানুষ বনের ভিতর গরু চড়িয়ে সোলার ফ্যান্সিংগুলো ধ্বংস করে ফেলে।

এলাকাবাসীর জানমাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা মাথায় রেখে আবারও নতুন করে শ্রীবরদীর রাঙ্গাজান, খ্রিস্টানপাড়া ও বালিজুড়ি এলাকায় আট কিলোমিটার জুড়ে সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নষ্ট হয়ে যাওয়া সোলার ফ্যান্সিংগুলো মেরামতের জন্য বাজেট চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।এছাড়া হাতিকে বনে রাখার জন্য সরকারের সুফল প্রকল্পের আওতায় বিপুল পরিমাণ ওষুধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। এখন জনসাধারণকে বনের জ্বালানি কাঠ ও আগাছা কাটতে দেয়া হচ্ছে না। এর ফলে ওই এলাকা আরও গহীণ বনে পরিণত হবে। সেখানে থাকবে ফুড ফেস্টার বাগান (তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ), বাঁশ, কলা, কাঁশফুলের বাগান, আমলকি, হরতকি, বহেড়া ও চাপালি জাতীয় গাছ। এক সময় বনে আর হাতির খাবারের অভাব হবে না। পাশাপাশি হাতির খাবারের সংস্থান আরও স্থায়ীরূপ দিতে চিন্তাভাবনা চলছে।

শেরপুরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় ৭০ জন মারা গেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। অন্যদিকে নানা কারণে ২৫-৩০টি বন্য হাতির মৃত্যুও হয়েছে। এ পর্যন্ত বন্য হাতির আক্রমনে শতশত ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সহাস্রাধিক একর জমির ফসল, সবজি ক্ষেত ও ফল বাগান নষ্ট হয়েছে। হাতির তান্ডবে অনেক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষী পরিবার বেকার ও দিন মজুর হয়ে পড়েছে। শুধু শেরপুরের তিন উপজেলার ৩০ গ্রামের অন্তত ৫০ হাজার মানুষের জীবন কাটে হাতি আতঙ্কে।

নালিতাবাড়ী সীমান্তের বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকার এন্ডারসন সাংমা, লুইস নেংমিজা জানান, আগে মশাল জা¦লিযে, হৈ-হুল্লোড় করে হাতি তাড়ানো যেতো। এখন হাতি কোনটাই পড়োয়া করে না। উল্টো মানুষকেই ধাওয়া করে হাতি। পাহাড়ে হাতি গুলো খাদ্য ও পানিয় জলের চরম সঙ্কটে পড়েছে। তাই তৃষ্ণা মিটাতে হাতিগুলো পাহাড়ি কোন জলাশয় কিংবা নদীতে নেমে পড়ছে।

ঝিনাইগাতীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হক বলেন, সরকার সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা কোনো লোকবল নিয়োগ করেনি।
শেরপুর জেলা রেসস্পন্স টিমের সভাপতি উকিল উদ্দিন বলেন, আমাদের সীমান্তবতী উপজেলাগুলিতে দুই শতাধিক সদস্য রয়েছে। তারা প্রতিয়িত রাত দিন হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। মানুষকে মাইকিং করে সচেতন করছে এবং সহযোগিতা করছে।

নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খ্রিষ্টফার হিমেল রিসিল বলেন, জানা মতে বন বিভাগ থেকে হাতির অভয় আশ্রম তৈরির জন্য একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এদিকে উৎসুখ জনতা হাতি এবং স্নানীয় মানুষদের বিরক্ত করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। একই সাথে হাতির দ্বার যারা ক্ষতির মুখে পড়েছে, ক্ষতি পূরন হিসাবে যারাই আবেদন করছে তারা ক্ষতি পূরন পাবে।

মধুটিলা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সব সময় হাতি গুলোকে কেউ যাতে বিরক্ত না করে, সে বিষয়ে সচেতন করি। কারণ হাতি দ্বারা যে কোনো প্রকারের জান মালের ক্ষতির সন্মুখিন হলে সরকার তাদের ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করে। তবে গারোপাহাড়ে হাতি মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শেরপুর জেলা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার জানান, হাতি মানুষের সহবস্থান তৈরির জন্য ২৩ টি ইলিফেন্ট রেসপন্স টিম আবার সক্রিয় করা হচ্ছে। পাশাপশি হাতির অভয়াশ্রম তৈরির একটি প্রস্তাবনা বন বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন