প্রিয় পৃথিবী আটশ’ কোটি মানুষের গল্পে ঠাসা। যেখানে গল্পেরা ডানা ছড়িয়ে আছে জাতিতে জাতিতে, সমাজে সমাজে, দেশ থেকে মহাদেশে, কখনও মহাকাশে। প্রতিদিন নতুন গল্পের জন্ম হয়, বেড়ে ওঠে, কখনও নীরবেই হারিয়ে যায় সমাজে-রাষ্ট্রের কানাগলিতে। কিছু গল্প আবার নতুন পৃথিবীর জন্ম দেয়, আনে নতুন বার্তা। আধুনিক বিশ্বের বিস্ময়কর তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বার্তা পৌঁছে যেতে পারে প্রাণে প্রাণে, প্রতিটি গল্পের উৎসভূমিতে।
আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী সরকারি আজিজুল হক কলেজে এভাবেই কিছু ডানপিঠে গল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের পুরাতন ভবনের ক্যাম্পাসে পা ফেলা একঝাঁক সেরা মেধাবীর চোখেমুখে ছিল উপচেপড়া স্বপ্ন। শিক্ষাবর্ষের ঝড়োহাওয়ায় প্রাণে প্রাণে যুক্ত হওয়ার আগেই ১৯৯১ সালে দিতে হয় উচ্চমাধ্যমিক পাড়ি। এরপর স্বপ্নবাজ গল্পেরা ডানা মেলে অন্য দিগন্তে, অন্য কোনোখানে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কেউ দেশে, কেউবা বিদেশে। কারো কারো আবার শুরু হয় রক্তাক্ত লড়াইয়ের জীবন। এভাবেই সূতো ছিঁড়ে গল্পের ঘুড়িরা উড়তে থাকে নিজস্ব আকাশে।
প্রায় তিন দশক ধরে উড়ে চলা স্বপ্নের ঘুড়িগুলো এক সময় ভিড়তে থাকে সামাজিক মাধ্যমে। ফেলে আসা গল্প আর স্মৃতিরা হাতছানি দিতে থাকে। সেই প্রিয় ক্যাম্পাস সেই স্বপ্নের ঘোড় দৌড় চোখের সামনে এসে থমকে থমকে দাঁড়ায়। সামাজিক মাধ্যমের সার্চ ইঞ্জিন সূতা ছেঁড়া সেই ঘুড়িদের অবশেষে ঠিকানা দেয়। অদম্য প্রাণের কয়েকজন বন্ধুর প্রাণে বাজতে থাকে- তোমায় আমি বাঁধতে চাই না, রাখতে চাই না/ কাটতে চাই না, ছাড়তে চাই না/ স্মৃতির মতো ঘাটতে চাই না/ চাইছি তোমার বন্ধুতা…। আর সেই বন্ধুতার আহ্বানেই দূর আকাশে ভাসা স্বপ্ন আর গল্পেরা জড়ো হয় ১৬ সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায়, বগুড়ায়।
আবেগে তেত্রিশ বছরের ঘুম ভেঙে প্রথমবারের মতো সমাধ্যায়ীদের গল্পের ঝড় বইতে থাকে। মুখরতার মধ্যেই স্বপ্নের চোখে পড়া শুরু বর্তমান। সেই আড্ডা থেকেই প্রাথমিক সাংগঠনিক কাঠামো। সেই কাঠামোতেই গেঁথে ফেলা আগামীর স্বপ্নগুলো। এমন এক সমাজের স্বপ্ন চোখেমুখে যেখানে পঞ্চাশের সঙ্গে দশ-পনের কিংবা পঁচিশের স্বপ্নের থাকবে মিথস্ক্রিয়া। আটশ কোটি গল্পের মধ্যে সমাধ্যায়ীরাও লিখবে অন্যরকম এক পাণ্ডুলিপি। তাদেরও তো দেবার আছে, উজার করে অবশেষে।
স্বপ্নের পথ
শিক্ষাজীবনের মধুর স্মৃতিচারণে গড়ে ওঠা অসংখ্য অ্যালামনাই কিংবা পুনর্মিলনীর প্রথাগত জমকালো আয়োজনে সমাধ্যায়ীরাও কি আটকে থাকবে, নাকি অন্যকোনো বার্তা দিবে? এমন প্রশ্নেরা তাড়া করছে প্রতিনিয়ত। বর্তমান যখন বিবর্ণ হয়, তখনই পালিয়ে বর্ণিল অতীতে ডুব দেয়াতেই শান্তি। তাই বর্তমানকেই বর্ণিল করার স্বপ্ন হয়ে যায় সিলেবাসভূক্ত।
সমাধ্যায়ী ফয়জুল করিম খালিদের সাফ কথা, বড্ড দুঃসময়ে আছি বন্ধুরা। চারপাশের মূল্যবোধের ভয়াবহ দূষণ আমাদের মস্তিষ্কের কোষেও হানা দিয়েছে, দিচ্ছে। তাই আগে দূষণমুক্ত হতে চাই, তারপর না হয় উল্লাস করবো, অতীতে সাঁতার দিব। পরিবার আর সমাধ্যায়ীদের দিয়েই না হয় শুরু হোক সে অভিযান। ব্যক্তি, পরিবার আর সামষ্টিক জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র আর বৈষম্যহীনতার পথ খুলে যাক প্রতিটি পদক্ষেপে।
সমাধ্যায়ী ফজলুল হকের ভাষ্য, লাফিয়ে পনের কিংবা পঁচিশে গিয়ে অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেও দিন শেষে ঘরে ফিরতে হয় পঞ্চাশ হাতে নিয়েই। দায়-দায়িত্বের পাল্লাটাও ভারী হচ্ছে দিন দিন। অনেক তো নিয়েছি, দিতে চাই ফিরে এবার। ব্যক্তি থেকে শুরুটা যেন হয় সংগঠনের মোড়কে।
সমাধ্যায়ীদের যাত্রা শুরুর অন্যতম পরিকল্পক আশেকুল ইসলামের স্বপ্ন বহুমুখী। সামাজিক সংকটগুলোকে দিনের আলোয় নিয়ে আসা, সমাধানের উদ্যোগ নেয়া, বৈরী সময়ে বেড়ে যাওয়া মনস্তাত্ত্বিক সংকট কাটানো কিংবা সামাজিক অসচেতনার আগল ভাঙার স্বপ্ন তার চোখে মুখে। সমাধ্যায়ী-৯১ নিয়ে পরিকল্পনাটা তেমনি।
সমাধ্যায়ীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় অগ্রনায়ক নুরুল ইসলাম বলেন, প্রাণের টানেই সেতু বন্ধনের উদ্যোগ। সংগঠন নিয়ে প্রথগত ধারণা থেকেই কিছুটা বাধার মুখে পড়েছি। তবে বর্তমানে এসে দেখছি পরিশ্রম বৃথা যায়নি। আগামীতে আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ হবে আশা করছি।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় শহীদুর রহমান বিপ্লবের ভাষ্য, আগে ভিতটা মজবুত হোক, আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বাড়ুক, তারপরই বড় পরিকল্পনার বাস্তবায়নে উদ্যোগ। প্রাথমিক পুনর্মিলনীতে আলোচনা হবে, আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে কথা হবে।
আলুঘাটির মোড়কে পুনর্মিলনী
সরকারি আজিজুল হক কলেজের এইচএসসি-৯১ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সাংগঠনিক নাম পেয়েছে ‘এইচএসসি-৯১ সমাধ্যায়ী’। গেল কয়েক মাসে যোগাযোগ হয়েছে মজবুত। আড্ডাতেও বসা হয়েছে দফায় দফায় বগুড়ায় কিংবা ঢাকায়। আবেগ-উচ্ছাসের ঘোর কেটে শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) আলুঘাটি উৎসবের আড়ালে আয়োজন পুনর্মিলনীর প্রাথমিক ধাপ। সারাদেশ থেকে ছুটে যাচ্ছে সমাধ্যায়ীরা প্রাণের টানে।
ঢাকা থেকে উৎসবে যোগ দিতে চায় সমাধ্যায়ী সৈয়দা বদরুন নেসা। তার ভাষ্য, তেত্রিশ বছর আগের সেই শেকড়ের টানে ছুটছি। কতদিন হয়নি দেখা সেই প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় কত মুখ। জানি একসময় এই আবেগের চেয়ে বাস্তবতার দাবিই মূখ্য হবে। সেজন্য ‘সমাধ্যায়ী’ এর মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তথা সন্তানদের জন্যই বিশুদ্ধ সামাজিক রূপরেখা তৈরি করে দিতে হবে। ওরা ভালো থাকলেই ভালো থাকবে সমাজ-দেশ। ওদের ভালো রাখার দায় তো আমাদেরই।
সমাধ্যায়ী তাজরিনা আক্তার ববির কথা, অতীতের মধুর স্মৃতিচারণ কিন্তু বর্তমানকে সমৃদ্ধ করে। তবে শুধু স্মৃতিচারণেই আটকে থাকা নয়, বরং নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়া কিংবা রেখে যাওয়াটাও বিশেষ দায় আমাদের। সেটাই করতে চাই, ভাবতে চাই।
সমাজে বহুমুখী স্বপ্নের বীজ বোনায় বিভোর আশেকুলের শেষ কথা, পুনর্মিলনীতে আমরা আমাদের ভেতরের স্বপ্নগুলো মেলে ধরবো, তুলে ধরবো। সেই স্বপ্নেই সাজাবো ‘সমাধ্যায়ী’। পথরেখাও তৈরি হবে আগামীর। পুনর্মিলনী ঘিরে আশেকুলের ভেতরে সেই সুর খেলা করে- ‘যদি বন্ধু হও, যদি বাড়াও হাত/ জেনো থামবে ঝড়, মুছে যাবে এই রাত/ হাসিমুখ তুলে, অভিমান ভুলে/ রাঙা সূর্য বলবেই সুপ্রভাত’। আরও কিছু শব্দেরা জানান দিয়ে যায়- ‘পুরো পৃথিবী এক দিকে আর আমি অন্য দিক/ সবাই বলে করছ ভুল আর তোরা বলিস ঠিক/ তোরা ছিলি, তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি…’।
আনন্দবাজার/শহক