চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় প্রায় ৬২টি ইটভাটা রয়েছে। যার বেশির ভাগই কাগজপত্রবিহীন। বেশির ভাগই আইনের তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠেছে। উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে ইটের ভাটা। শুধু তাই নয় রাস্তার পাশে, স্কুল, কলেজের পাড় ঘেঁষে, লোকালয়ে, ফসলি জমির উপর এসব ভাটা গড়ে উঠেছে। চব্বিশ ঘণ্টাই চলতে থাকে ভাটার চুল্লি। সেই ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। যা পুরো সাতকানিয়াকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে।
অপরদিকে, ইট ভর্তি ট্রাক আঞ্চলিক সড়কে চলার কারণে ৫০ বছর টেকসই রাস্তা এখন ২ বছরও টেকসই হচ্ছে না। তবে একটু ব্যতিক্রম দৃশ্য চোখে পড়ে। উপজেলার বেশিরভাগ ভাটাই স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ফসলি জমিতে গড়ে তুলেছে অবৈধ ইটভাটা। যা গিলে খাচ্ছে ফসলী জমির মাটি। দিন দিন কমে যাচ্ছে জমির পরিমাণ। দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। হতে পারে খাদ্য ঘাটতিও।
ইটভাটা বন্ধের প্রতিবাদে সাতকানিয়াবাসী সোচ্চার থাকলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ পরিবেশ লঙ্ঘন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই উপজেলায় প্রায় ৬২টি ইটভাটায় গড়ে উঠেছে। এর পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা। কাগজপত্রবিহীন অবৈধ ক্ষমতার বলে অধিকাংশ ইটভাটার মালিকেরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রসাশনকে ম্যানেজ করে গড়ে তুলেছেন তাদের ভাটা। আর এসব ভাটা থেকে টাকার বিনিময়ে বৈধতা দিয়েছেন ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সদস্যরা।
ইটভাটার কারণে এক দিকে ক্ষতি হচ্ছে ফসলি জমির। অপরদিকে পরিবেশের। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো ধুলায় ভর্তি থাকে সব সময়। ভাটার পাশে কোনো গাছপালার ফলও ধরে না। মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই জেঁকে বসেছে দূষিত পরিবেশের জন্য। স্কুল, কলেজের সাথে ইটভাটা গড়ে উঠার কারণে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের হাঁচি কাশি জনিত রোগ ব্যধিত লেগেই থাকে।
ইটভাটার ট্রাক রাস্তার পাশ দিয়ে চলাচলের কারণে কারণ মাটির ট্রাক থেকে মাটি পড়ে রাস্তা ধুলায় একাকার হয়ে যায়। জনজীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। সেই কারণে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করতে গেলে ধুলো দিয়ে সারা শরীর ডেকে যায়। একটু বৃষ্টি হলে কাদায় রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যায় না। এছাড়া ইট উৎপাদনের জন্য জমির টপ সয়েল কেটে নেয়া হচ্ছে, জমিতে পানির জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। আবাদি জমি এখন পতিত পড়ে রয়েছে। ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতিসাধন করে ক্ষমতার ধাপট দেখিয়ে তিন ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে ইট তৈরি করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রমতে, ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন (২০১) ধারায় সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ আছে, জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স ব্যতিত কোনো ব্যক্তি ইটভাটা প্রস্তুত করতে পারবে না। ঐ আইনে আরও উল্লেখ করা আছে যে তিন কিলোমিটারের মধ্যে বাড়ি ঘর ও বসতি এলাকা ফলজ ও বনজ-বাগান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে ইটভাটা অনুমোদন হবে না। কিন্তু সাতকানিয়া উপজেলায় সেই আইনের তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা যেগুলো মানুষের বসতি বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফলজ ও বনজ বাগানের নিকটে গড়ে উঠেছে। ফলে মানুষ ও ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে। অধিকাংশ ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড় পত্র ও জেলা প্রসাশকের লাইসেন্সবিহীন গড়ে তুলেন।
অন্যদিকে দেখা মিলেছে ইটভাটাগুলোতে থরে থরে সাজানো কাঁচাইট। রোদে শুকানোর পর এগুলো উঠছে চুল্লিতে। আগুনের তাপে পুড়ছে ইট। সেই সঙ্গে পুড়ছে যেন শিশুর স্বপ্নও। কারণ, এসব ইটভাটায় অনেক শিশু লেখাপড়া বাদ দিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি সাতকানিয়া উপজেলার কয়েকটি ইটভাটায় দেখা যায়, ভাটাশ্রমিকের সঙ্গে শিশুরাও কাজ করছে। ওদের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।
কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব শিশুর কেউ কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ছে। আবার কেউ কেউ এখন আর বিদ্যালয়ে যায় না। কেউ নিজে থেকেই, আবার কেউ মা-বাবার সঙ্গে ইটভাটার কাজে এসেছে। কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত এসব শিশু।
এই ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, ইটভাটার কারণে দিন দিন কমে আসছে জমির পরিমাণ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৬ বছরে সাতকানিয়া উপজেলায় খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা হ্রাস পাবে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা দৈনিক আনন্দ বাজারকে বলেন, আমরা গতবছরও অনেকগুলো অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছি। এবছরও জেলাপ্রশাসক থেকে নির্দেশ এলে অভিযান চালানো হবে।
আনন্দবাজার/শহক