বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশে বছরে ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি

অর্থনীতির ভয় বায়ুদূষণ

আর্থনীতির ভয় বায়ুদূষণ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত নিয়ে কিছুটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমদানি, রপ্তানি আর হুন্ডির নামে অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে। এমনকি ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করার মতো ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। এমন ঘনঘটার মধ্যে বায়ুদূষণ নিয়ে কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা একেবারেই নেই। অথচ বাতাস দূষিত হলে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এমন কথা কারো ব্যক্তিগত নয়, উঠে এসেছে খোদ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ ইভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের সেই প্রতিবেদন গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবেদনের প্রধান ওয়ামেক আজফার রাজা বলেন, বায়ুদূষণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন বায়ুর গুণগতমানকে আরও খারাপ করে। সময়ের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নগরায়ন বায়ুদূষণকে আরও তীব্র করবে। গত ২০১৯ সালে বায়ুদূষণে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৯ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতির কারণ। অর্থাৎ ক্ষতি হয়েছে। ওয়ামেক আজফার আরও বলেন, পরিবেশে বায়ুদূষণ শিশু থেকে বয়স্ক সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণ ছিল বাংলাদেশে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার (অক্ষমতার) দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ। একই সঙ্গে দেশের জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৯ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতির কারণ। প্রতিবেদনটি ১২ হাজার ২৫০ জনের মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর বিগত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। দেশে সবচেয়ে বেশি জিডিপি অর্জন হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে ৩টি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যথা-১. প্রতিনিয়ত যানবাহন চলাচল (স্থায়ী ট্রাফিক), ২. বড় বড় উন্নয়ন ও ট্রাফিক এবং ৩. ইটভাটা। প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণ, সেইসাথে বিষণ্নতা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থার ঝুঁকি বাড়ায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক এবং ডায়াবেটিস, হার্ট বা শ্বাসকষ্টের মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

আরও পড়ুনঃ  চুক্তিতে রাইড শেয়ার : চালক ও যাত্রী উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

ঢাকা ও সিলেটের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বহিরঙ্গন বায়ুদূষণের প্রভাবের মূল্যায়ন করা হয়েছে প্রতিবেদনে। স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব কমানোর জন্য প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্য পরিষেবা এবং প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়ার উন্নতি, বায়ুদূষণ ডেটা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি, প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ এবং আরও গবেষণায় জড়িতসহ অবিলম্বে বেশকিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ঢাকা শহরের বড় বড় নির্মাণ এবং ক্রমাগত যানবাহনসহ সাইটগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এই সাইটগুলোতে সূক্ষ্মকণা পদার্থ (পার্টিকুলেট মেটার (বস্তু কণা)-পিএম ২ দশমিক ৫ শতাংশ), যা স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনস (একিউজি) থেকে গড়ে ১৫০ শতাংশ বেশি, যা প্রতিদিন প্রায় ১ দশমিক ৭ সিগারেট ধূমপানের সমতুল্য। বৃহত্তর ঢাকার ইটভাটার কাছে পাওয়া গেছে পিএম ২ দশমিক ৫ মাত্রার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্ব। যা ডব্লিউএইচও একিউজি’র ১৩৬ শতাংশ বেশি। এটি যা প্রতিদিন ১ একিউজি ৬ সিগারেট খাওয়ার সমান।

ইটভাটাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় প্রধান নির্মাণ এবং যানজটের কাছাকাছি বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি পাওয়া যায়। সিলেট বিভাগে যেখানে দেশের সবচেয়ে বিশুদ্ধ বায়ু রয়েছে, সেখানে এখনও গড় পিএম ২ একিউজি ৫ ঘনত্বের মাত্রা ডব্লিউএইচও একিউজি’র ৮০ শতাংশ বেশি। এটি প্রতিদিন ১ দশমিক ২ সিগারেট খাওয়ার সমান।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষক লিউক পারসনসের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘শ্রমে বর্ধিত ক্ষতি এবং উষ্ণায়িত বিশ্বে অভিযোজনশীলতা হ্রাসের সম্ভাব্যতা’ গবেষণায় জানানো হয়, গড় তাপমাত্রা বর্তমানের তুলনায় আরো ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে উৎপাদনশীলতা কমে বিশ্বজুড়ে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার। এর ফলে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বৈশ্বিক গড়ে প্রতিবছর জনপ্রতি ১৩৪ কর্মঘণ্টা কমবে। আর বাংলাদেশের কমবে ৩৯১ ঘণ্টা।

এ হিসাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বার্ষিক জনপ্রতি কর্মঘণ্টা কমবে ৫৭৩ ঘণ্টা। তাতে বার্ষিক ক্ষতি ২৮ থেকে ৩১ হাজার কোটি ডলার। ক্ষতির সিংহভাগ ভার বহন করবে স্বল্প ও মধ্যআয়ের দেশগুলো। যাদের কৃষি ও নির্মাণশিল্প মানবশ্রমনির্ভর। তবে তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বড়জোর ৩০ মিনিট কর্মঘণ্টা হারানো রোধ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ  সিলেটের ‘গোয়ালগাদ্দা’ আনছে বৈদেশিক মুদ্রা

লিউক পারসনসের গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বাংলাদেশ বছরে জনপ্রতি ২৫৪ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। তাতে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৫৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যদি বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আরো এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তবে এ ক্ষতি ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। তাতে বাংলাদেশে ৩৯১ কর্মঘণ্টা কমবে। মূলত কর্মঘণ্টা কমে যাওয়ার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে উৎপাদনখাতে। পরিবেশের অন্যান্য নেতিবাচক প্রভাবের কারণও কর্মঘণ্টা তথা ব্যক্তির উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলছে।

গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রীষ্মকালে সারাদিন ধরে বাড়তে থাকে উত্তাপ ও আর্দ্রতা। প্রচণ্ড গরমে অল্পতেই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন মানুষ। তাতে প্রতিবছর বাংলাদেশ জনপ্রতি ২৫৪ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় একদিন হলে এক মাসে ৭২০ ঘণ্টা। ১২ মাস অর্থাৎ এক বছরে ৮ হাজার ৬৪০ ঘণ্টা। সেখানে ২ শত ৫৪ কর্মঘণ্টা হারালে বাকি থাকে ৮ হাজার ৩৮৬ ঘণ্টা। প্রতিদিন কর্মঘণ্টা ৮ হলে মাসে ২৪০ ও বছরে ২ হাজার ৮৮০ ঘণ্টা। সেখানে বাদ যাবে ২৫৪ ঘণ্টা তাতে অবশিষ্ট থাকে ২ হাজার ৬২৬ ঘণ্টা।

‘ব্রিদিং হেভি: নিউ ইভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদন সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভুটানের বিশ্ব ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান্ডান চেন বলেন, বায়ু দূষণ মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের টেকসই ও সবুজ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন। বিশ্লেষণমূলক কাজ এবং নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে প্রায় ৭৮ হাজার ১৪৫ থেকে ৮৮ হাজার ২২৯ জন মারা গেছে। যদিও দেশের অভ্যন্তরে বায়ু দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। তবে সমস্ত অঞ্চলে পিএম ২ দশমিক ৫ এর ঘনত্ব ডব্লিউএইচও এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা দ্বারা সুপারিশকৃত ক্ষতির উপরে। সবচেয়ে দূষিত বিভাগ ঢাকা এবং সবচেয়ে কম দূষিত সিলেট। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসাবে স্থান পেয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল (খুলনা ও রাজশাহী) পূর্বাঞ্চলের (সিলেট ও চট্টগ্রাম) চেয়ে বেশি দূষিত।

আরও পড়ুনঃ  অনাবাদি থাকলেই খাস জমি নয়

ঢাকা বিভাগে স্থানীয় দূষণ উৎস ছাড়াও মোট পিএম ২ দশমিক ৫ ঘনত্বের এক-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত আন্তঃসীমান্ত উৎস থেকে আসে। ডব্লিউএইচও একিউজি’র তুলনায় পিএম ২ দশমিক ৫-এর সংস্পর্শে এক শতাংশ বৃদ্ধির ফলে একজন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা ১২ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ভেজা কাশি হওয়ার সম্ভাবনা ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি ৮ দশমিক ১ শতাংশ বেশি হতে পারে। নিম্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, বায়ু দূষণ মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। বড় নির্মাণ এবং ক্রমাগত ট্র্যাফিকসহ অবস্থানগুলোতে বিষণ্ণতা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ডব্লিউএইচও একিউজি’র ওপরে পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণে এক শতাংশ বৃদ্ধি হতাশাগ্রস্ত হওয়ার জন্য ২০ শতাংশ উচ্চ সম্ভাবনায় যুক্ত।

ওয়ামেক আজফার রাজা বলেন, বায়ু দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত আসন্ন স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতকে ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। জরুরি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে নিরাময়মূলক যত্ন প্রদানের জন্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা প্ল্যাটফর্মের উন্নতি এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রচার অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। বায়ু দূষণের হটস্পটগুলোতে বসবাসকারী লোকদের জন্য ক্রমাগত কাশি এবং শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য স্ক্রিনিং উদীয়মান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করবে।

প্রতিবেদন প্রধান বলেন, বায়ুমানের তথ্যের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং আরও গবেষণা বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলো মোকাবিলা করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করতে সহায়তা করবে। ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০২০: বায়ুদূষণ কীভাবে সারাবিশ্বে আয়ুষ্কালকে প্রভাবিত করে’ শিরোনামে হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণে প্রতিজনের আয়ুষ্কাল কমেছে গড়ে তিন বছর।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন