স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত ৪৮ বছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়েছে ২ হাজার ১২১ মার্কিন ডলার। দারিদ্রতা কমেছে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ। পরিবর্তন এসেছে জনজীবনের মান উন্নয়নেও। কেননা ১৯৭২ সালে যেখানে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয় করা হতো ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ সেটি ২০১৯ এসে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-বিআইডিএসের বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনে ‘ম্যাক্রোইকোনোমিক ম্যানেজমেন্ট ইন এ পোস্ট-কোভিড আনসারটেইন গ্লোবাল এনভাইরনমেন্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধে এসব তথ্য জানা যায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি, বিশেষ অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ও সম্মানিত অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিইট-পিআরআই এর ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।
এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বর্তমানে ইতিবাচক। তবে কর জিডিপির অনুপাত মন্দের চেয়েও খারাপ। এটি আসলেই এতো ভয়ংকর মন্দ হলে জিডিপির ৬ বা ৭ যে অর্জন হয়েছে তা কীভাবে হলো? দীর্ঘ প্রতিযোগিতা হলে যে ৮ বা ৬ এর প্রত্যাশা অর্জন হবে কিনা বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী গবেষণার মান ও পরিমাণ আরো বাড়াতে বলেছেন। আমরা কেন আরো গবেষণা বাড়াতে পারছি না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরের কমেছে। আমরা ইতিবাচক ফলাফল চাই আইনের ফাঁক-ফোকর নয়। সম্পদ অপচয় বা পাচার হবে এটি হতে পারে না। আমরা চাই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্যখাতের অর্থনীতি বৃদ্ধি পাক। অনেক সময় মনপুত কথাও শুনতে চাই। যদিও সব সময় এসব কথা ভালো লাগবে না। তবুও শুনতে চাই। সমালোচনাকে স্থান দিতে চাই। দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো আছে এতে সন্দেহ নেই। অযথা মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে সমালোচকদের বিরত থাকার আহ্বানও জানান তিনি।
ড. শামসুল আলম বলেন, গ্রোথ রেট ৬ শতাংশ যে প্রত্যাশা করা হয়েছে তা হবে। যদিও প্রথমে তা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত রেমিটেন্স এসেছে ৭ দশমিক ১৮ বিলিয়ন যা গত বছর ছিল ৭ দশমিক ০ শতাংশ। ১৬ বিলিয়ন রপ্তানি করা হয়েছে। ট্যাক্স ২৬ শতাংশ গ্রোথ না হলে বাজেটে সমস্যা হবে। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, গতবছরের চেয়ে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক। জিডিপি ৭ শতাংশের ওপরে থাকতে পারে। ‘২০২৩-২৪ সালে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণশোধ করতে পারবে না’ বুদ্ধিজীবীদের এসব কথার প্রভাব সমাজে পড়ে। তাই তাদের কথা বলার সময় এদিকে মনোযোগ দিতে। যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
মূলপ্রবন্ধে সাদিক আহমেদ বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গ্রোস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট-জিএনপি ছিল ১০০ মার্কিন ডলারের নিচে। দারিদ্রতার হার ছিল ৮০ শতাংশ। যুদ্ধে আমাদের অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। উৎপাদন কমে জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যায়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতায় দ্রুত উন্নত হয়।
সাদিক আহমেদ তার ‘ম্যাক্রোইকোনোমিক ম্যানেজমেন্ট ইন এ পোস্ট-কোভিড আনসারটেইন গ্লোবাল এনভাইরনমেন্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ১৯৭২ সালে মোট জাতীয় আয়-জিএনআই এর হার ছিল মাথাপিছু ৮৮ মার্কিন ডলার, দারিদ্রতা ছিল ৮২ শতাংশ, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ছিল ২০ দশমিক ২ শতাংশ, জনসংখ্যার জন্মে হার ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০০০ সালে মোট জাতীয় আয়-জিএনআই এর হার বেড়ে মাথাপিছু দাঁড়ায় ৫৮১ মার্কিন ডলার, দারিদ্রতা নেমে আসে ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার উন্নীত হয় ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ, জন্ম হার কমে ১ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়।
২০১৯ সালে মোট জাতীয় আয়-জিএনআই এর হার বেড়ে হয় ২২০৯ মার্কিন ডলার, দারিদ্রতা কমে আসে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার বেড়ে হয় ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ, জন্ম হার আরো কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
সাদিক আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী তথা ২০১৯ সালে জিডিপি গ্রোথ ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ২২০৯ মার্কিন ডলার, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট রেট ছিল ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ইনফ্লেশন ছিল (মাস থেকে মাস) ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ, মোট রপ্তানি (জিএনএফএস) ছিল ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, প্রবাসী রেমিটেন্স আয় হয় ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ, মোট রপ্তানি থেকে আয় হয় ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ, আমদানি ছিল ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ, মোট আমদানি পরিশোধ করা হয় ৬৯ দশমিক ০ শতাংশ এবং নিট ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার আঘাত আসে। ফলে এ বছর জিডিপি গ্রোথ কিছুটা ভাটা পড়ে। তারপরও এ বছর জিডিপি গ্রোথ ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে ২৩২৬ মার্কিন ডলার, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট রেট ছিল ২৪ দশমিক ১ শতাংশ, ইনফ্লেশন বেড়ে (মাস থেকে মাস) ৬ দশমিক ০ শতাংশ হয়, তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ২৮ দশমিক ০ শতাংশ, মোট রপ্তানি (জিএনএফএস) ছিল ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রবাসী রেমিটেন্স আয় হয় ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, মোট রপ্তানি থেকে আয় হয় ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ, আমদানি ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ, মোট আমদানি পরিশোধ করা হয় ৬২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং নিট ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০২১ সালেও করোনার প্রকোপ ছিল। সে বছর জিডিপি গ্রোথ ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে ২৫৯১ মার্কিন ডলার, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট রেট ছিল ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ, ইনফ্লেশন বেড়ে (মাস থেকে মাস) ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হয়, তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে নেমে আসে হয় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, মোট রপ্তানি (জিএনএফএস) ছিল ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ, প্রবাসী রেমিটেন্স আয় হয় ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ, মোট রপ্তানি থেকে আয় হয় ৬৯ দশমিক ৯ শতাংশ, আমদানি ছিল ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ, মোট আমদানি পরিশোধ করা হয় ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং নিট ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, কোভিড-১৯ চলাকালে তথা ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত আমি অর্থসচিব ছিলাম। কোভিডে কীভাবে খাদ্য নিশ্চিত করা যায়, নিম্ন-আয়ের মানুষের আয় বন্ধ হওয়াদের আর্থিক সুবিধা প্রদান, শিল্প টিকিয়ে রাখাসহ ৫টি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। এসবের সুফল বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। সাড়ে ৪ শতাংশ জিডিপি কমেছে কোভিডে। তবে টিকায় বিপুল সাফল্য ছিল সরকারের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি মানি সাপ্লাই থেকে আসেনি। এটি আমদানির কারণে হয়েছে। খাবারের ও জ্বালানি তেলের ১০০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। গম আনতে হয়। ডলার রেট বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে। ডিমান্ড কমাতে হবে। সাপ্লাইয়ে নিজস্ব উৎপাদন করবো। ইম্পোর্ট কন্ট্রোল কোনোভাবেই হচ্ছে না। তবে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। সেখানে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিং দেখা গেছে। এজন্য কিছু এলসি বন্ধ করা হয়েছে। আন্ডারিং ভয়েস সম্পর্কে বলেন, আমদানিকারকরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়েছে। তারা ১০ টাকার জিনিস ৩০০ টাকা দিয়ে কিনেছে। এসব টাকা কোথায় পেল?
ফরেন রেমিটেন্স সম্পর্কে বলেন, হুন্ডিওয়ালারা ব্যাংকের চেয়ে বেশি টাকা দেয়। তার কারণে প্রবাসীরা হুন্ডি করছে। কার্ব মার্কেট ১১৪ টাকার স্থলে এখন ১০৪ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। রেমিটেন্স আনতে আইন সহজ করতে হবে। ব্যাংক কোনো চার্জ নিবে না। এখন মোবাইলে রেমিটেন্স আনা যাবে। আগামী বছরের ৩-৪ মাসের মধ্যেই এসব করা সম্ভব হবে।
সাদিক আহমেদ তার প্রবন্ধে বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের ট্যাক্স আদায়ের হার ছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। এ বছরে বাংলাদেশে ট্যাক্স আদায় হয় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ১০ দশমিক ১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে ডেনমার্কে। দেশটিতে আদায় হয় ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ফ্রান্সে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ, সুইডেনে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ।
আনন্দবাজার/শহক