সম্প্রতি একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইসলামী ব্যাংকসহ তিনটি ব্যাংক থেকে আট প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আর চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর নেওয়া হয় ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইসলামী ব্যাংক থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ ধরনের পণ্য আমদানিতে ইসলামী ব্যাংক ঋণ বাড়িয়েছে। যথাযথ মূল্যায়নের পর পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ ও ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ঋণ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেছেন, এসব প্রতিষ্ঠানকে যে অর্থায়ন করা হয়েছে, তার বড় অংশই আমদানির জন্য। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে খাদ্য কেনাকাটাসহ অন্য অর্থায়নও রয়েছে। আশা করছি, সময়মতো ঋণের টাকা ফেরত আসবে। কাগুজে নতুন কোম্পানিকে অর্থায়ন প্রসঙ্গে মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, সারাদেশে খাদ্য পরিবেশক হিসেবে কাজ করছে এমন যে কাউকে ইসলামী ব্যাংক অর্থায়ন করে থাকে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর তা নজরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। পরে গত ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১১টি প্রতিষ্ঠানের ৯,১৩৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় বন্ধ ঘোষণা করে। বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে ঋণ ছাড় বন্ধ রাখতে হবে। মূলত, ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১ প্রতিষ্ঠানকে আগ্রাসীভাবে ঋণ দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই অংশ হিসেবে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমাদের একটি টিম ব্যাংকটি পরিদর্শন করে এসব অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়েছে। এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। যদিও ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষটির মুখপাত্রও কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের টিম কাজ করবে। ইতোমধ্যে তারা দুদিন ইসলামী ব্যাংকে গেছেন। তারা আরও চারদিন সেখানে যাবেন।
রিট করতে বললেন হাইকোর্ট
ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া ও এস আলম গ্রুপের ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনায় রিট করার পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পরামর্শ দেন।
ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন উচ্চ আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি আদালতের কাছে আদেশ প্রার্থনা করেন। তখন হাইকোর্ট বলেন, প্রতিবেদনগুলো সংযুক্ত করে রিট আবেদন আকারে কোর্টে আসুন। এসময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান উপস্থিত ছিলেন। পরে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আমরা আজই আদালতে রিট করবো।
গত ২৪ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের প্রথমাংশে বলা হয়, ব্যাংকের নথিপত্রে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডের অফিসের ঠিকানা বনানীর বি ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ভবন। ঋণ পাওয়া মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে মিলল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অফিস। তবে মার্টস বিজনেস লাইন নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এভাবেই ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র।
সব মিলিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর সময়ে। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এ জন্যই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা চলতি মাসকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ বলে অভিহিত করছেন।
একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার-সংকটের পর টাকার সংকট বড় আলোচনার বিষয়। এরপর গত ২৯ নভেম্বর অপর একটি পত্রিকায় এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি ঋণ নিয়েছে- এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনটিও আদালতের নজরে আনা হয়।
কোনো ব্যাংকই দেউলিয়া হবে না
দেশের কোনো ব্যাংকই দেউলিয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেছেন, দু-একটি ঘটনার কারণে গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে রায় দেওয়া উচিত নয়। গতকাল বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। মন্ত্রী আরও বলেন, কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ব্যাংকে টাকা নেই। শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। তাই গ্রাহকদের অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা তোলার জন্য হুড়াহুড়িও লেগে যায় বলে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা স্পষ্ট করে বলেন যে, এসব তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমাদের ব্যাংকিং খাত নিয়ে এখন অনেক আলোচনাই হচ্ছে। কিছু কিছু বিষয় গণমাধ্যমেও আসছে। তবে দু-একটি ঘটনার কারণে গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে রায় দেওয়া উচিৎ নয়। পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, এখানে আইন রয়েছে, অন্যায় হয়ে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ব্যাংকই দেউলিয়া হবে না। কয়েকদিন আগে একটা গুজব ছড়িয়েছিল যে ব্যাংকে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। যেটা সম্পূর্ণ ভুল। একটা শ্রেণি অসৎ উদ্দেশ্যে এসব গুজব ছড়ায়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, সরকার এখন কিছুটা চাপে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে মিতব্যয়ী হতে বলেছেন। মূল্যস্ফীতি এখন নিম্নগামী। খাদ্য, তেল, গ্যাসের দাম কমছে। আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। আগামী মাসে এটা আরও কমে যাবে।
আনন্দবাজার/শহক