ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতার ইতিহাসের রেকর্ড ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৮ সালে রাশিয়া যে খরচ করেছিল, তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭টি বিশ্বকাপের একত্রিত খরচকেও হার মানিয়েছে কাতার।
করোনার ছোবলে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় যখন গলদঘর্ম, ঠিক তখনই বাগড়া বসায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ক্রমাগত ধস নামতে থাকতে বিশ্ব অর্থনীতিতে। দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কায় পড়ে বেশ কয়েকটি দেশ। এমন পরিস্থিতে দরজায় কড়া নাড়ে ফুটবল বিশ্বকাপ। যার একক আয়োজক আরবের দেশ কাতার। ফুটবল বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞ আয়োজনে ভয় পায়নি কাতার। ২০১০ সালে ফিফার থেকে আয়োজক স্বত্ত্ব পাওয়ার পরই কাতার ঘোষণা দেয়, বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবে তারা। বিশ্ব অর্থনীতির এই সংকটকালেও কথা মতো কাজ তাদের।
১২ বছরের ব্যবধানে কাতারকে পাল্টে ফেলেছে আয়োজকরা। বলা হয়ে থাকে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশের মধ্যে সবচেয়ে খরুচে দেশ কাতার। সর্বশেষ আসরে যেখানে খরচ করা হয়েছিলো দেড় হাজার কোটি ডলার সেখান থেকে এক লাফে ৩০ হাজার কোটি ডলার খরচ করলো কাতার। যা সবগুলো আসরের সমন্বিত খরচের চেয়ে বেশি। এই আসর থেকে লাভজনক হওয়ার স্বপ্নেই এতো বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, কাতার লাভবান হওয়ার দিবাস্বপ্নেই বিনিয়োগ করেছে। তবে এ স্বপ্ন কতটুকু পুরণ হবে তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। আয়োজকেরা অবশ্য বলছেন, এসব অবকাঠামো শুধু বিশ্বকাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এগুলো বিশ্বকাপ শেষেও কাজে লাগবে। তবে যে পরিমাণ বিনিয়োগ তাতে কতটুকু কাজে লাগবে, আর তাতে কতটা বিনিয়োগ উঠে আসবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, বিশ্বকাপের আয়োজনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটি নিজেরই ব্র্যান্ডিংটা বাড়িয়ে নিচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্টের খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতার এরই মধ্যে খরচ করে ফেলেছে ৩০ হাজার কোটি ডলার। খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত খরচ আরও বাড়বে। অথচ ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে খরচ করেছিল মাত্র ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার, ২০১৮ সালে রাশিয়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার খরচ করেছিল। তথ্য মতে, বিশ্বকাপ আয়োজনে দেশটি যে অর্থ খরচ করেছে, তা মূলত অবকাঠামো নির্মাণে। যার বড় অংশই খরচ হয়েছে মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরিতে। বিশ্বকাপের খেলা দেখতে ১৫ লাখ মানুষ এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবেন। তাদের যাতায়াত সহজ করতে এই মেট্রোব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিশ্বকাপের আসর থেকে কাতারের অর্থনীতিতে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি যোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কাতার বলছে, এবারের ফিফা বিশ্বকাপে তারা ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর যা কিনা বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আয়োজন। ২০১৮ সালে রাশিয়া যে পরিমাণ খরচ করেছে, কাতার বিশ্বকাপে তার ২০ গুণ বেশি ব্যয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭টি বিশ্বকাপের একত্রিত খরচকেও হার মানিয়েছে আয়োজক দেশটি।
সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো ৩৬টি বড় আয়োজনের মধ্যে ৩১টি আয়োজন লাভজনক হয়নি। গবেষণায় যে ১৪টি বিশ্বকাপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মধ্যে কেবল একটির আয়োজন লাভজনক ছিল। আর সেটি ছিল ২০১৮ সালে রাশিয়ার ফুটবল বিশ্বকাপ। ওই বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়া ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার মুনাফা করেছিল। মূলত বিশ্বকাপের প্রচারস্বত্ব বিক্রি করে এই মুনাফা করে দেশটি। তবে বিনিয়োগের বিপরীতে সেটা আবার খুব বেশি লাভজনক হয়নি, বিনিয়োগের বিপরীতে রাশিয়া ওই আয়োজন থেকে মুনাফা করেছিল মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
গ্লোবাল ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এসএন্ডপি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে কাতার বিশ্বকাপে ১৫ লাখের বেশি মানুষ অংশ নেবে। এতে শুধু কাতার নয় অঞ্চলটির অন্যদেশগুলোর ওপরও অর্থনীতির ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিবেদনে বলা হয়, উগসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিবেশীরাও অনেক ফুটবল ভক্ত পাবে। এতে তাদের পর্যটনের পাশাপাশি বিমানখাতও লাভবান হবে। যাদের কাছে বিশ্বকাপের টিকিট থাকবে তাদের কাতারে থাকার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। অর্থাৎ যাদের কাছে টিকিট থাকবে না তাদের জন্য কাতারে রুম পাওয়া খুব কঠিন হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোতে থাকতে যাবেন অনেকেই। মূলত অঞ্চলটি জুড়েই বাড়তি সুবিধা পেতে যাচ্ছে। তবে এসঅ্যান্ডপি প্রত্যাশা করছে কাতারের বাইরে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী, স্বল্প মেয়াদে চিন্তা করলে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখেই পড়বে আয়োজক দেশ। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যা টাকার চেয়েও বড়। বিশ্বকাপ আয়োজন করলে পুরো বিশ্বকে নিজের সক্ষমতা দেখানোর সুযোগ থাকে। যাতে করে বড় বড় ব্যবসায়ী এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবলে, কাতার যদি সঠিকভাবে টুর্নামেন্টটি পরিচালনা করতে পারে, তাহলে দেশটির অর্থনীতি আরও ব্যাপকভাবে প্রসারিত করার সুযোগ তৈরি হবে।
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নতুন সড়ক ও যোগাযোগ প্রকল্পগুলো দেশকে অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দেবে। বড় আন্তর্জাতিক স্পোর্টিং ইভেন্টগুলো সামাজিক ভেদাভেদ দূর করে এক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে লোকগুলোকে একত্রিত করে তোলে। ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল ২০১৮ শীতকালীন অলিম্পিকের বেলায়। বৈরী সম্পর্ক থাকার পরও সেবার এক ছাতার নিচে ছিল দুই প্রতিবেশি দেশ দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া। এই ইভেন্টগুলো শিশুদের খেলাধুলায় আরও আগ্রহী করে তোলে। যা একটি দেশকে অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়।
তাই বিশ্বকাপ আয়োজন করা একটি দেশের জন্য টাকার চেয়েও বেশি গর্বের এবং সম্মানের। একইসঙ্গে প্রচারের উপযুক্ত মাধ্যমও। বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সব খরচ আয়োজক দেশের। ফিফা কেবল প্রতিযোগিতার পরিচালনব্যয় নির্বাহ করে। অথচ রাজস্ব আয়ের বড় অংশই নেয় ফিফা। টিকিট বিক্রি, পৃষ্ঠপোষকতা, সম্প্রচার স্বত্ব- সবকিছুই থাকে ফিফার হাতে। গত বিশ্বকাপ থেকে ফিফা ৫৪০ কোটি ডলার আয় করে। এ আয়ের একটি অংশ বিভিন্ন দেশকে দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালে করা হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালের আয়োজনে ফুটবলার প্রতি মাথাপিছু ব্যয় হয়েছিল ২ লাখ ডলার। আর ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনে খরচের সেই অঙ্ক একলাফে উঠে গেল ৭০ লাখ ডলারে। প্রতিটি প্রতিযোগিতার জন্য নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করার যে রীতি চালু হয়েছে, সে কারণেই ব্যয় এতটা বেড়েছে। এবার কাতারে সাত-আটটি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে একটি স্টেডিয়ামও তৈরি করতে হয়নি।
লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় শুধু স্টেডিয়াম নির্মাণ, উপকরণ ও মানবসম্পদ বাবদ খরচকে হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু একটি ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সঙ্গে আরও অনেক পরোক্ষ ব্যয় থেকে যায় যেমন কাতারের মেট্রো কাঠামো, নতুন নতুন হোটেল তৈরি ইত্যাদি। কিছু কিছু কাঠামো আবার দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির জন্য উপকারী। কিন্তু ব্যয়বহুল স্টেডিয়াম অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে অব্যবহৃত থেকে যায়। ফলে এ বিনিয়োগ অর্থনীতিকে খুব বেশি চাঙা করতে পারে না।