কক্সবাজারের আট উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ উপকূলীয় অঞ্চলের ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ চাষ শুরু হয়েছে। বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় লবণচাষে জড়িত ৪৫ হাজার প্রন্তিক চাষি। এসব লবণমাঠে নিয়োজিত আছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিক। শুধু তাই নয়, লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন, মধ্যসত্ত্বভোগী ও মিল মালিক মিলে দেশের ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ লবণশিল্পের সরাসরি সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যানুযায়ী দেশের চাহিদা মাথায় রেখে এবার লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। লবণের দাম ভালো থাকায় এবার ১৫/২০ দিন আগেই মাঠে নেমেছেন চাষিরা। কুতুবদিয়ার লেমশিখালীসহ উপকূলজুড়ে লবণমাঠগুলোতে কালো পলিথিন বিছিয়ে সমুদ্রের লোনা পানি শুকিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে লবণ। উৎপাদিত লবণের ন্যায্যদা পেয়ে খুশি স্থানীয় চাষিরা।
তথ্যমতে, গেল বছরে প্রতিমণ লবণ বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত। নতুন মৌসুমের শুরুতেই মাঠে উৎপাদিত লবণ বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৫০০ টাকা পর্যন্ত। চাষিরা বলছেন, লবণের এই মূল্য অব্যাহত থাকলে জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদিত হবে। এমন অবস্থায় জাতীয় চাহিদা মিটিয়ে লবণ বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বিসিকের তথ্যমতে, দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৫০ হাজার টন।
বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, কুতুবদিয়ার পাশাপাশি টেকনাফ, পেকুয়া ও কক্সবাজার সদর,মহেশখালী, চকরিয়া, ঈদগাহ, বাঁশখালী ও উখিয়া উপজেলার অন্তত ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষে নেমেছেন ৪০ হাজারের বেশি চাষি। গত ২ নভেম্বর থেকে এসব মাঠে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ দিনেই উৎপাদিত হয়েছে ৮ হাজার ৭৫৫ টন লবণ। গেল মৌসুমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ২০ নভেম্বর থেকে।
তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে ১৫ নভেম্বর থেকে আগামী বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাসে জেলার টেকনাফ, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, চকরিয়া ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ জমিতে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত মৌসুমে কক্সবাজারের ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৩ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। গেল মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৩১ টন। এবার তিন হাজার একর বেশি জমিতে লবণ চাষে লবণ উৎপাদন বেড়ে যাবে।
কুতুবদিয়ার লেমশিখালীর লবণ চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, এ বছর লবণের দাম ভালো আছে। মৌসুম অনুকূলে থাকলে লবণের বাম্পার ফলন হতে পারে। টেকনাফের চাষি নুরুল করিম বলেন, আবহাওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আর বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ থাকলে এবার লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। তাছাড়া এবার বেশি লাভের আশায় চাষিরা সনাতন পদ্ধতির বদলে শতভাগ মাঠে পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন করছেন। এই প্রযুক্তিতে দ্বিগুণের বেশি লবণ উৎপাদিত হচ্ছে।
কুতুবদিয়ার উত্তর ধূরং এর লবণ চাষি নুর আহমদ জানান, নভেম্বরের শুরু থেকে মাঠে লবণ উৎপাদন করছেন। ইতোমধ্যে ৮০ মণের বেশি লবণ বিক্রি করেছেন। আরও ১০০ মনের বেশি লবণ মজুত আছে। গতবছর প্রতিমণ লবণ বিক্রি করেছেন সর্বোচ্চ ৩১০ টাকায়। এবার বিক্রি করছেন ৪৮০ টাকায়। প্রতিমণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে খরচ হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকার মতো। লবণ লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় আরও কয়েকশ চাষি উৎসাহিত হয়ে মাঠ সংস্কারে নেমেছেন।
টেকনাফ সাবরাং এর লবণ চাষি নুর কাদের ও হ্নীলার রফিকুল হাসান বলেন, এখন প্রতিমণ লবণ তারা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। কিন্তু লবণ আমদানি হলে তাদের লোকসান গুনতে হবে- এই শঙ্কায় অনেকে লবণ চাষে নামতে সাহস পাচ্ছেন না।
কয়েকজন লবণচাষি বলেন, বিদেশি লবণে বাজায় সয়লাব হওয়ায় গত মৌসুমে প্রতিমণ লবণ বিক্রি করতে হয়েছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিকেজি লবণের দাম পড়েছিল সাড়ে ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা। যদিও বাজারে প্যাকেটজাত লবণের খুচরা মূল্য ছিল ২৫ থেকে ৪৫ টাকা। এবারও যদি সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়, তাহলে লবণ উৎপাদনে চাষিরা নিরুৎসাহিত হবেন।
মহেশখালী উপজেলা লবণচাষি সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, এবার উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া গেলেও লবণ আমদানির গুজবে চাষিদের আতঙ্ক কাটছে না। চাষিরা চায় না, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হোক। এ ক্ষেত্রে চাষিদের প্রশিক্ষণ, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার ও লবণ উৎপাদন বাড়াতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
সরেজমিন উপকূল ঘুরে এসে বিসিক লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, গত মৌসুমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ২০ নভেম্বর থেকে। এবার উৎপাদন শুরু হয়েছে ২ নভেম্বর থেকে। মাঠে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, যা গত মৌসুমে বিক্রি হয়েছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার লবণের বাম্পার উৎপাদনের আশা করছেন চাষিরা।
কক্সবাজার লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, এখন মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে চাষিরা খুশি। চাষিরা যেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা আছে। যদিও গত কয়েক বছর ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের চক্রান্তে প্রান্তিক চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার লবণ আমদানি বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি উৎপাদন দ্বিগুণ করতে পলিথিন প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে।
মহেশখালী-কুতুবদিয়া অর্থাৎ কক্সবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, আমি নিজেও একজন লবণ চাষি। গেল কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় লবণ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তাই লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারায় লবণ আমদানি হয়েছে। ফলে চাষিরা অব্যাহতভাবে ন্যায্য মূল্য না পেয়ে চরমভাবে হতাশ ছিল। তারপরও লবণের ঘাটতি ছিল না সারাদেশে।
দেশীয় লবণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। তারপর কিছু অসাধু চক্র সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে লবণ আমদানি করে। এতে চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। অবশ্য গত বছর থেকে লবণের দাম ভালো থাকায় এ বছর চাষিরা আগেভাগে মাঠে নামে। উৎপাদন ও ভালো হচ্ছে। তাই এ বছর আশা করা যেতেই পারে লবণ উৎপাদন টার্গেট অতিক্রম করবে।
উল্লেখ্য, দেশের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ লবণ মহেশখালীতেই উৎপাদন হয়। এ দ্বীপের চার লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ লবণ চাষের ওপর নির্ভরশীল। দেশীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ এই লবণ শিল্পকে বাচাঁতে বিদেশি লবণ আমদানি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন চাষিরা। তারা বলছেন, উপকূলীয় এলাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৪৫ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই মুহূর্তে লবণ আমদানি করা হলে চাষিরা মাঠে মারা যাবেন। তাই লবণচাষে জড়িতদের ন্যায্যমূল নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীসহ শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আগেই অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
জানতে চাইলে বিসিক কক্সবাজারের লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মৌসুম শুরুর ১০ থেকে ১৫ দিন আগেই চাষিরা মাঠে নেমেছেন। গত প্রায় ২৫ দিনে ইতোমধ্যে ৮ হাজার ৭৫৫ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে পুরোদমে শতভাগ লবণমাঠে উৎপাদিত হবে।
জাফর ইকবাল ভূঁইয়া আরও বলেন, গত মৌসুমে ঘাটতি মেটাতে পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে দেড় লাখ টন লবণ আমদানি করা হয়। তবে এখন আর আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, ইতোমধ্যে মাঠে উৎপাদিত লবণ বাজারজাত হচ্ছে। তাছাড়া কক্সবাজারে শতভাগ মাঠে পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। যাতে লবণের গুণমানও ভালো। দামও বেশি পাওয়ায় চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। এতে লবণ চাষে উৎসাহ বাড়ছে উল্লেখ করে বিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, এবার কক্সবাজারের লবণ দিয়েই দেশের জাতীয় চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে। এর ওপর আবার গত মৌসুমের লক্ষাধিক টন লবণ মজুদ আছে।
যেভাবে লবণ উৎপাদন
এবার আগে ভাগেই মাঠে নেমেছেন চাষিরা। তারা আগেই দেখা পেয়েছেন লবণের। গত সেপ্টেম্বরে মাঠ সমান করে লবণ চাষের উপযোগী করে তোলেন তারা। মাঠের ছোট ছোট বেট বিছানো হয় কালো পলিথিন। এরপর সমুদ্রের লোনা পানি ঢোকানো হয়। মাঠ একটু উঁচু নিচু করে বিশেষ কায়দায় বানানো হয় লবণ উৎপাদনের জমি। যাতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে অনায়াসে পানি চলাচল করতে পারে। এরপর কাঠের তৈরি রোলার দিয়ে লবণ বেট বা পলিথিন বিছানো ঘর সমান করতে হয়।
এভাবে কয়েক দফা পানি দিয়ে তারপর শুকিয়ে লবণ উৎপাদনের উপযোগী করে তুলতে হয়। উপরের তিন থেকে চার ঘরে লবণ উৎপাদন হয় না। পানিতে লবণের গাঢ়ত্ব বেড়ে গেলে নিচের পলিথিন বিছানো ঘরে পানি দেয়া হয়। তারপর পলিথিনের ওপর জমানো লোনা পানি সূর্যতাপে শুকিয়ে জমাট বাঁধে সাদা লবণের আস্তর। বিকেলে পলিথিনের ওপর থেকে সেই লবণ কুড়িয়ে মজুত করা হয় মাঠের এক কোণে বা গর্তে।