ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অপপ্রচার রোধে সতর্কতা

অপপ্রচার রোধে সতর্কতা

ব্যাংকখাতে সংকট

  • বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকলেও তারল্যে নেই। তারল্য নিয়ে গুজব চলছে: সেলিম আর এফ হোসেইন, চেয়ারম্যান, এবিবি
  • মানুষ যাতে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে বিশ্বাস না করে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে: আবুল কালাম আজাদ, মুখপাত্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক
  • অপপ্রচারে আতঙ্কিত গ্রাহকরা আমানত তুলে নিলে ব্যাংকিংখাতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে: আব্দুর রউফ তালুকদার, গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ব্যাংকে চলছে তারল্য সংকট। দায় মেটানোর অর্থ নেই একাধিক ব্যাংকের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে কয়েকটি ছবি। যেগুলোতে লেখা এক লাখ টাকার বেশি তুলতে হলে একদিন আগে জানাবেন। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। বন্ধ রয়েছে কমার্শিয়াল এলসি। তবে সবগুলো বিষয়কে গুজব এবং অপ্রপচার বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন।

‘এক লাখ টাকার বেশি উত্তোলন করতে হলে আগের দিন জানাবেন’ গত কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে, ট্যুইটার ও ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হওয়া এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন। ব্যাংকে রাখা আমানত নিয়ে শঙ্কার কথা তারা ফেসবুকে লেখেন। অনেকেই বলেন, চাহিদা মতো টাকা তুলতে পারছেন না ব্যাংক থেকে। এতে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। পক্ষে-বিপক্ষে চলে আলোচনা-সমালোচনা।

এর মধ্যে গুজবের আগুনে ঘি ঢালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা বিক্রির খবর। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় গত ৩ নভেম্বর এক নিলাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, অবৈধভাবে আসা বা চোরাচালানের সময় জব্দ করা সোনা নিলামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক লটে ২৫ হাজার ৩১২ গ্রাম (২৫.৩১ কেজি) বা ২ হাজার ১৭০ ভরি সোনা বিক্রি করা হবে। ১৪ থেকে ২০ নভেম্বরের মধ্যে আগ্রহীরা নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। চলতি মাসেই সোনা বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ খবরটিকে অনেকেই ভেবে নিয়েছেন ব্যাংক অর্থ সংকটের কারণে জমিয়ে রাখা সোনা বিক্রি করছে। যা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে গ্রাহকদের মাঝে বাড়িয়ে দেয় আতঙ্ক।

লক্ষ্মীপুরের আবু সোয়াইব রনি। চাকরি করছেন ঢাকার একটি কোম্পানিতে। তিনি জানিয়েছেন ব্যাংকে তার কিছু টাকা জমা রয়েছে। বিগত কয়েকদিনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ব্যাংক নিয়ে নেতিবাচক লেখায় তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তিনি জানতে চাচ্ছেন তার টাকা কি ব্যাংকে নিরাপদ আছে? তিনি কি এখন টাকা তুলে ফেলবেন? কোন কোন ব্যাংক খারাপ অবস্থায় রয়েছে? এমন নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্ট এবং সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলছেন, পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে তার টাকা তুলে ফেলবেন তিনি। শুধু রনি নয় এমন শঙ্কায় রয়েছেন দেশের হাজারো গ্রাহক। অনেকেই আবার আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলেও নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অনেকে আবার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন। যে যত বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মুখি তিনি ততো বেশি শঙ্কিত।

এমন পরিস্থিতিতে ১৩ নভেম্বর জরুরিভাবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমানত তুলে নেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচারিত হচ্ছে। ব্যাংকখাত নিয়ে যে কোনো গুজব প্রতিরোধে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর একদিন আগে ব্যাংকের এমডিদের নিয়ে একটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর পরদিন গত ১৪ নভেম্বর ডাকা হয় জরুরি সংবাদ সম্মেলন। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র লিখিত বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত দেশের কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়নি এবং হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচারিত হচ্ছে। সেখানে বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকের আমানত তুলে নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থ নেই বা তারল্য সংকট আছে। কিন্তু এটি সত্য নয়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্যেও কোনো সংকট নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানত ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা, যা আগের মাসের চেয়ে ১১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে মোট তারল্যের পরিমাণ ৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট নেই।

ব্যাংকের তারল্য সংকটের বিষয়ে গত ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, একটি মহল দূরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশের কোনো কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে মর্মে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ফলে, ক্ষুদ্র আমানতকারীগণ আতংকিত হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। অপপ্রচারের কারণে ব্যাংকিংখাতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ ধরনের মিথ্যাচার প্রসূত ঝুঁকি হ্রাসকল্পে গণমাধ্যম/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাংকসমূহ নিজেরা এবং ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে তাদের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক বক্তব্য তুলে ধরতে হবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেইন বলেন, দেশের কিছু ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট রয়েছে। কিন্তু তারল্যে সংকট নেই। কিছু দুষ্টু লোক ব্যাংকের তারল্য নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। মানুষ যদি এসব গুজবে বিশ্বাস করে তাহলে তারল্যে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর কোনো ব্যাংক গায়েব হয়েনি। দুই-একটি ব্যাংকে সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তার সমাধান হয়েছে।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ব্যাংকখাতে তারল্যের সংকট নেই। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে সুযোগসন্ধানী চক্র ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। মানুষ যাতে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে বিশ্বাস না করে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো ব্যাংকে যদি তারল্য বা অন্য কোনো সংকট দেখা দেয় তাহলে সংকট সমাধানে সহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনালে (বিসিসিআই) সমস্যা তৈরি হয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকটির মালিকানা বদল হয়ে নতুন নাম হয় ইস্টার্ন ব্যাংক। বিসিসিআইর অধিকাংশ গ্রাহককেই আমানত ফেরত দিয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক। ২০০৬ সালে দেউলিয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। মালিক পক্ষের লুটপাটের কারণে রুগ্ণ হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিক পক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। এরপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আছে।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকে সমস্যা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে। ব্যাংকটির সংস্কার করে নাম রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ছোট আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিয়েছে তারা। বড় আমানতকারীরা এখনো আমানত ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন