ঢাকা | বৃহস্পতিবার
৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হজে নতুন মাত্রা

হজে নতুন মাত্রা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ সম্পর্ককে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বিষয়টিকে ভিত্তি ধরে ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’ বিষয়ে ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে দৈনিক আনন্দবাজার। আগামী ২০২৩ সালের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশে সফরে আসবেন সৌদি যুবরাজ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। তার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আমন্ত্রণে ১২ ও ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশে সফর করে গেলেন সৌদি আরবের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. নাসের বিন আব্দুল আজিজ আল দাউদ। এ সময় দুটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ-সৌদি আরবের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে প্রথম বিশেষ প্রতিবেদন ‘হজে নতুন মাত্রা’।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছিল। তারা বলেছিল, পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে ভারত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিতে যাচ্ছে। এমন গুজবে কানভারী হয়েছিল সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের। সেই বিভ্রান্তি থেকে সৌদি আরব বেরিয়ে না এসে উল্টো ১৯৭৪ সালের ২২ হতে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে তৎকালীন সৌদি বাদশা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। যে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সৌদি বাদশার শর্ত ছিল বাংলাদেশের নামের সঙ্গে ইসলামি যুক্ত করতে হবে। না করলে সৌদি আরব স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। সেই শর্তের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন সৌদি আরবের স্বীকৃতির কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু মুসলমান হিসেবে আল্লাহর ঘরে হজ করার অনুমতি দিলেই হবে। কারণ, হজ পালন বিশ্বের সব মুসলমানের হক। কারো কোনো দয়া নয়। সেই সময় বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন তুলেছিলেন, সৌদি আরবের নিজের নামেই তো ইসলামি নয় বরং রাজকীয় সৌদি আরব লেখা। আগে নিজেদের দেশের নামে ইসলাম আনেন। পরে অন্যদের উপদেশ দেন। অবশেষে সেই সৌদি সরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার পরদিন ১৬ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

তথ্যমতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ মুসল্লি হজ করতে সৌদি আরবে গিয়ে থাকেন। সেখানে তারা নানা সমস্যার মুখোমুখি হন। যার মধ্যে ইমিগ্রেশন বড় সমস্যা। যার সমাধানে সম্প্রতি নতুন একটি দিক উন্মোচনে মনোযোগ দিয়েছে দেশ দুটি। গত ১২ ও ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশে সফর করেন সৌদি উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. নাসের বিন আব্দুল আজিজ আল দাউদ। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় সৌদি উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ থেকে হজে গমনেচ্ছু যাত্রীদের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম এখন ঢাকা থেকেই সম্পন্ন করা যাবে।
রুট-টু-মক্কা সার্ভিস এগ্রিমেন্টের আওতায় বাংলাদেশ থেকে হজে গমনেচ্ছুরা সৌদি আরবে যাত্রার আগে তাদের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া ঢাকা থেকেই সম্পন্ন করতে পারবেন।

সৌদি উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে আরও জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে সৌদি সরকার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাথে এই রুট-টু-মক্কা সার্ভিস চুক্তি করতে যাচ্ছে। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহযোগিতার জন্য সৌদি বাদশাহ, সৌদি যুবরাজ এবং সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। সৌদি উপমন্ত্রী বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। উপমন্ত্রী অভিন্ন পারস্পরিক স্বার্থে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্য সৌদি আরবের আগ্রহের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতে সহযোগিতা আরও জোরদার করতে সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।

এক্কাগ্লোবালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনসংখ্যা ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন। প্রতিবছর মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে হজ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সৌদি আরব সরকার এবং ট্যুর অপারেটর, আতিথেয়তা পরিষেবা প্রদানকারী এবং খুচরা বিক্রেতাদের জন্য একটি বিশাল অর্থনীতির ক্ষেত্র। ২০১৭ সালে প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন মুসলমান হজের জন্য মক্কায় এসেছিল। এর মধ্যে প্রায় ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন সৌদি আরবের বাইরে থেকে আসে।

ওমানের ল ফার্ম ট্রওয়ারস অ্যান্ড হ্যামলিনসের অংশীদার টমাস উইগলি বলেছেন, আপনি যদি খুব অল্প সময়ের মধ্যে আসা লোকের সংখ্যা সম্পর্কে চিন্তা করেন তবে এটি একটি বিস্ময়কর। হজ ইসলামিক চান্দ্র ক্যালেন্ডারের (যিল-হিজ্জাহ) শেষ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এবং রমজান মাস অনুসরণ করে ঈদ উল আজহার ছুটির সাথে মিলে যায়। হাজিরা সাধারণত বেশ কয়েক দিন আগে পৌঁছান এবং প্রায়শই এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকেন, যার ফলে প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব আয় হয় এবং হজ সৌদি আরবের হাইড্রোকার্বনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়কারী অবস্থান।

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক পরামর্শদাতা গালফ স্টেট অ্যানালিটিকসের সিনিয়র উপদেষ্টা থিওডোর কারাসিক বলেছেন, মক্কা ও মদিনার জন্য যে অর্থ উপার্জন করে এবং হজ লজিস্টিক ট্রেনের জন্য হজ শিল্প সম্ভবত সৌদি আরবের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলির মধ্যে একটি।

তথ্যমতে, ওমরাহ বাবদ বিগত ২০১৭ সালে ৮ মিলিয়ন হজযাত্রী সৌদি আরবে যান। এতে দেশটির ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উপার্জন হয়। তার ভিশন ২০৩০ কৌশলের অধীনে, সরকার ওমরার জন্য বছরে ৩০ মিলিয়ন আকর্ষণ করার পরিকল্পনা করেছে। মক্কা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অনুসারে, মক্কা ও মদিনার আশেপাশের অঞ্চলে বেসরকারিখাতের আয়ের ২৫-৩০ শতাংশ হজযাত্রীদের ওপর নির্ভর করে। সৌদি আরব হজ কোটা নির্ধারণ করে ওআইসির চুক্তির ভিত্তিতে, প্রতিটি প্রেরণকারী দেশে মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রতি মিলিয়নে ১ হাজার যাত্রীকে অনুমতি দেয়। ২০১৯ সালের সৌদি চেম্বার্স কাউন্সিলের জাতীয় রিয়েল এস্টেট কমিটির মতে, হজ এবং ওমরাহ পরবর্তী পাঁচবছরে দেশে ১৫০ বিলিয়ন আয় তৈরি হওয়ার কথা। আরও ১ লাখ স্থায়ী হজ-সম্পর্কিত চাকরি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

চলতি বছরের জুলাই মাসে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারিতে ২০২০ সালে হজ তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ১ হাজারে নেমে এসেছিল। ২০২১ সালে এটি প্রায় ৬০ হাজারে পৌঁছেছিল। তখন হজ শুধুমাত্র সৌদি আরবের বাসিন্দাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্র ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র পণ্ডিত রবার্ট মোগিলনিকি বলেছেন, সৌদি আরবে ধর্মীয় পর্যটনের তেল ও গ্যাস সেক্টরের বর্তমান আয়-উৎপাদন ক্ষমতা নাও থাকতে পারে, কিন্তু মক্কা ও মদিনার ধর্মীয় তাৎপর্য কখনই শুকিয়ে যাবে না।

মাস্টারকার্ডের সর্বশেষ গ্লোবাল ডেস্টিনেশন সিটি ইনডেক্স অনুসারে, মক্কা ২০১৮ সালে ২০ বিলিয়ন পর্যটক ডলার আকর্ষণ করেছে, যা দুবাইয়ের পরেই দ্বিতীয়। হজযাত্রীদের থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন হজযাত্রীদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে।

দুই বছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ৭০ হাজার নতুন হোটেল রুম এবং ৯ হাজার আবাসিক ইউনিটসহ কাবা থেকে মাত্র এক মাইলের নিচে রওআ আল হারাম আল মক্কি প্রকল্প খোলার পরিকল্পনা করেছে। সৌদি অর্থনীতিতে এটি ৮ বিলিয়ন রিয়াল (২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন