সালটা ছিল ১৯৮৭। সময়টা ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রামের। স্বার্থপর কিছু রাজনীতিবিদ ছাড়া দেশের আপামর জনগোষ্ঠী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে একাট্টা। সব রাজনৈতিক দল, কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মেহনতি জনগণ কেউ ঘরে বসে নেই। সবার জোরালো স্লোগান- এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি? যতই দিন যায় ততই আন্দোলন-মিছিলের কারণে স্বৈরাচার এরশাদসহ তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের বুকে কাঁপন ধরাচ্ছিল।
এভাবে এলো ১০ নভেম্বর। আচমকা জনমিছিলে সামিল হলো জ্বলন্ত এক আগ্নেয়গিরি, যেন জীবন্ত এক পোস্টার। নাম- নূর হোসেন। তখনকার জননেত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা দেখে বললেন, ‘তোমার বুকে-পিঠে ওই লেখাগুলো দেখলে পুলিশ গুলি করবে।’ নূর হোসেন তার মাথাটা নেত্রীর গাড়ির জানালার কাছে নিয়ে বললেন, ‘আপা, আপনি আমাকে দোয়া করেন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।’
জামাটা ছিল কোমড়ে বাঁধা, উদোম শরীর, মুষ্টিবদ্ধ হাত, বুকে-পিঠে লেখা ছিল বন্ধু ইকরাম হোসেনের লিখে দেওয়া ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান। যা ছিল স্বৈরাচারের আতঙ্কের মন্ত্র। এতে স্বৈরাচারের বুকে কাঁপন ধরে যায়। স্লোগানটা স্বৈরাচারের পছন্দ হলো না। ভয়ে কাতর স্বৈরাচারের দালালেরা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির আগুন থেকে বাঁচতে চায়। মিছিলটি ঢাকা জিপিও’র সামনে এলে স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনী চালিয়ে দেয় নূর হোসেনের বুকে গুলি।
এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় জীবন্ত পোস্টারটি। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। রক্তে লাল হয়ে যায় কালো পিচ ঢালা রাজপথ।
সুমন নামের এক যুবক মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করা নূর হোসেনকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় গোলাপ শাহ মাজারের কাছে পৌঁছলে পথ রোধ করে দাঁড়ায় স্বৈরাচারের পেটুয়া বাহিনী পুলিশ। তারা মরণাপন্ন নূর হোসেনকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নেন। এক নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য তার পায়ের বুট দিয়ে বুকে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে গণতন্ত্র রক্ষায় শপথ নিয়ে নামা আগুন চোখের অস্থির ক্ষ্যাপা, স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ জানানো এলোমেলো চুলের দুঃসাহসি তরুণের। মুহূর্তে সেই দাবানল সারাদেশ ছেয়ে গেল।
গণতন্ত্র রক্ষার্থে সেই নূর হোসেন নামক পোস্টারটির মৃত্যুই ত্বরান্বিত করে স্বৈরাচার এরশাদের পতন। নূর হোসেন হয়ে উঠেন বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। সেদিন আরো দু’জন গণতন্ত্রের আন্দোলনে নিজেদের বলি দেন। একজন হলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল এবং অন্যজন হলেন আমিনুল হুদা টিটু। সেদিন নূর হোসেনের প্রাণ বিসর্জন এ দেশের গণতন্ত্রের পথ সুগম করেছিল। সেই কথা আমরা ভুলে যাইনি। প্রান্তিক শ্রেণির এমন ব্যক্তিত্ব, নূর হোসেনের মতো সাধারণ পরিবারের সাধারণ অথচ নিবেদিত, সততায় পরিপূর্ণ দেশপ্রেমিক সন্তানের কদর এখনো পর্যন্ত স্বৈরাচারের দোসরেরা বুঝতে পারেন না। তাই তারা মাঝে মাঝে বিষেদাগার করতে ভোলেন না। যা প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
তাইতো কবি শামসুর রহমান ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই
তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর
করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ
ওর নাম, হোমরা চোমরা তারা, যারা
তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ
জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে
জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,
ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুঁড়ে থুথু শুধু থুথু।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার কাটিবুনিয়া গ্রামের মুজিবুর রহমান ও মরিয়ম বিবির সন্তান মোটরচালক নূর হোসেনের পুরো পরিবার ছিল শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্ভুক্ত। সংসারের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া বেশি করতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত পিতার মতো তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। গ্রামের মাঠে-ক্ষেতে ও শহরের বস্তিতে কয়েক প্রজন্ম ধরে গড়ে ওঠা পরিবারের সন্তান নূর হোসেন রাজনীতির কেউকেটা না হলেও স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের।
পরিশেষে বলবো, গণতন্ত্রকে হৃদয়ে ধারণ করে যিনি শেষ যাত্রায় সামিল হয়েছেন, তিনি অমর অক্ষয়। যতদিন বাংলা আর বাঙালি থাকবে, ততদিন তিনি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় সদা জাগ্রত থাকবেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার ৩৫তম আত্মাহুতি দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
আনন্দবাজার/শহক