বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সিত্রাংয়ের তাণ্ডব----

শিশু-বৃদ্ধাসহ প্রাণহানি ১৬, নিখোঁজ ৮

শিশু-বৃদ্ধাসহ প্রাণহানি ১৬, নিখোঁজ ৮

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে দেশের ৯ জেলায় অন্তত ১৬ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। ভোলায় চারজন, কুমিল্লায় তিনজন, গোপালগঞ্জের দুজন, সিরাজগঞ্জে দুজন, পটুয়াখালীতে একজন, বরগুনায় একজন, শরীয়তপুরে একজন, নড়াইলে এক নারী ও রাজধানীতে এক রিকশাচালকসহ ৯ জেলায় মোট ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো পাঠানো প্রতিবেদনে :

ভোলা প্রতিনিধি : ভোলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলায় চারজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত পাঁচজন। এর মধ্যে সোমবার রাতে তিনজন ও মঙ্গলবার ভোরের দিকে একজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চেওয়াখালী গ্রামের মো. মফিজুল ইসলাম (৬০), দৌলতখান পৌর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের খাতিজা বেগম (৬০), চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের মো. মনির হোসেন (৩০) ও লালমোহন উপজেলার লর্ডহাডিঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের রাবেয়া বেগম (২৫)। এর মধ্যে সদরের মফিজুল ইসলাম একটি গাছ ভেঙে বসতঘরের ওপরে পড়লে চাপা পড়ে নিহত হন। দৌলতখানের খাতিদা বেগমও ঘরের ওপর গাছ পড়ে চাপায় নিহত হন। এছাড়া চরফ্যাশনের হাজারীগঞ্জে মনির মোটরসাইকেল করে যাওয়ার সময় গাছের ডাল ভেঙে শরীরে পড়ে নিহত হন এবং লালমোহনের রাবেয়া বেগম জোয়ারের পানিতে ডুবে নিহত হন। ভোলা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম ভোলা সদর ও দৌলতখানের হতাহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কুমিল্লা ব্যুরো : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হেসাখাল এলাকায় ঝড়ে গাছ পড়ে একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হচ্ছেন হেসাখাল খামার পাড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন(২৮), তার স্ত্রী সাথী আক্তার (২৪) এবং তাদের শিশু কন্যা লিজা (৪)। তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন  হেসাখাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার মজুমদার। তিনি জানান, রাতে প্রবল বেগে বাতাস শুরু হলে তাদের ঘরের উপর একটি গাছ ভেঙ্গে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয়। নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান মেহেবব জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝড়ে গাছ পড়ে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।

আরও পড়ুনঃ  কাল শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ঝড়ে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার সয়দা ইউনিয়নের পূর্ব মোহনপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- পূর্ব মোহনপুর গ্রামের খোকন সেখের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) ও তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)। নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে দুই ছেলেসহ এক গৃহবধূ মোহনপুর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নৌকাযোগে পূর্ব মোহনপুর গ্রামে ফিরছিলেন। পথে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবিতে ঘটনাস্থলে এক ছেলের মৃত্যু হয়। এসময় অপর ছেলে ও তার মাকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মাকেও মৃত ঘোষণা করেন।

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গাছচাপায় দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচকাহনিয়া ও বাঁশবাড়িয়ার চরপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী সারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়িয়ার চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮)। মঙ্গলবার সকালে টুঙ্গিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আবুল মনসুর ওই দুজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওসি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে রাত সোয়া ৮টার দিকে উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের ঘরের ওপর চম্বল গাছ উপড়ে পড়ে। এতে ঘরটি বিধ্বস্ত হয়ে গাছচাপায় তার স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮) মারা যান।

বরগুনা প্রতিনিধি : বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট ঝোড়ো বাতাসে বসতঘরে গাছ উপড়ে পড়ে আমেনা খাতুন নামে ১১৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ৮টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ওই বৃদ্ধার স্বজনরা জানান, সোমবার রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া ঝড়ো বাতাসে তাদের বাড়ির পাশে থাকা চাম্বল গাছ উপড়ে বসতঘরের ওপর পড়ে। এসময় ঘর ও গাছের নিচে চাপা পড়ে আমেনা খাতুন ঘটনাস্থলেই মারা যান। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় মৃতের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে জেলা প্রশাসন। মৃতের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা করা হবে।

আরও পড়ুনঃ  চোর সেজে স্ত্রীকে খুন, নেপথ‌্যে পরকীয়া

নড়াইল প্রতিনিধি : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝড়ে নড়াইলে গাছের ডাল পড়ে মর্জিনা বেগম (৩২) নামে এক গৃহপরিচারিকার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকালে লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, মর্জিনা বেগম বাগেরহাটের স্থায়ী বাসিন্দা। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ছেলে জিহাদকে (১১) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লোহাগড়া পৌর এলাকার রাজুপুর গ্রামের আব্দুল গফ্ফারের বাড়িতে ভাড়া থেকে বিভিন্ন বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন তিনি। অন্যান্য দিনের মতো সোমবার সকালে বাসা থেকে কাজের উদ্দেশে বের হন তিনি। পথে লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বর এলাকায় পৌঁছালে মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে গুরুতর আহত হয় মর্জিনা। স্থানীয়রা মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী সাগর উপকূলীয় কদমরসুল এলাকায় একটি শিপইয়ার্ডের পাশ থেকে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটির নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। তার বয়স অনুমানিক ছয় থেকে সাত মাস হবে।

মঙ্গলবার সকালে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় শিপইয়ার্ড কর্মকর্তারা জানান, এদিন সকালে ইয়ার্ডের দারোয়ানরা জোয়ারের পানিতে একটি শিশুর মরদেহ ভাসতে দেখে কুমিরা নৌ পুলিশকে জানান। পরে নৌ পুলিশ ও গাউছিয়া কমিটির সদস্যরা মরদেহটি উদ্ধার করেন। পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারণা, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় অথবা জলোচ্ছ্বাসের কারণে শিশুটি পানিতে পড়ে মারা যেতে পারে। মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  লালমনিরহাটে দুই বাংলাদেশীকে বিএসএফের গুলি করে হত্যা

মিরসরাই ( চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সাগরে থাকা ড্রেজার ডুবে ড্রেজারস ৮জন শ্রমিক নিখোঁজ হয়েছেন। সোমবার রাত ১০টার দিকে নিখোঁজ হওয়ার পর এখনো সন্ধান মেলেনি। উপজেলার ১৬নং সাহেরখালি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ৩নং বসুন্ধরা এলাকায় বেড়িবাঁধ থেকে ১০০০ ফুট দূরত্বে সাগরের মাঝে রাখা বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিন রাখা ছিলো। মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা মঙ্গলবার সকাল থেকে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে।

ঘুর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে সাগরের জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়ায় ওই স্থানে রাখা বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিন সৈকত-২ পানিতে ভেসে গিয়ে ডুবে যায়। ড্রেজারে অবস্থানরত শ্রমিক শাহীন মোল্লা (৩৮),ড্রেজার চালক ইমাম মোল্লা(৩২), মাহমুদ মোল্লা (৩২), ।আলামিন (২১), তারেক, আবুল বশর (৪৫) ও আরো অজ্ঞাত দুইজন নিখোঁজ হন।  সকল শ্রমিকের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি ,  মোল্লাবাড়ি থানায়।

বালু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত ড্রেজারে থাকা শ্রমিক আব্দুস সালাম বলেন, ড্রেজারে আমি সহ ৯ জন শ্রমিক ছিলাম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা শুনে সন্ধ্যা অনুমান ৭টার দিকে  আমি ড্রেজার থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে চলে আসি। বাকিরা ড্রেজারেই অবস্থান করছিলেন।

মিরসরাই থানার অফিসার ইনচার্জ কবির হোসেন বলেন, সাগরে ড্রেজারসহ ৮ শ্রমিক নিখোঁজের খবর পেয়ে একটি টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। সংশ্লিষ্ট কোস্টগার্ড কমান্ডার কে বিষয়টি মোবাইলে  অবগত করে তাদের কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। পরে ফায়ার সার্ভিসকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে কোস্টগার্ডের মিরসরাই স্টেশনের কন্টিজেন্ট কমান্ডার জহিরুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার কল করেও সংযোগ স্থাপন করা যায়নি। এ বিষয়ে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের কর্মকর্তা ইমাম হোসেন পাটোয়ারি বলেন, খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকাল আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। তবে এখনো পর্যন্ত কাউকে উদ্ধার করা যায় নি।

সংবাদটি শেয়ার করুন