ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঋণহীন রাষ্ট্র ব্রুনাই

ঋণহীন রাষ্ট্র ব্রুনাই
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ সম্পর্ককে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বিষয়টিকে ভিত্তি ধরে অর্থনৈতিক কূটনীতি বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দৈনিক আনন্দবাজার। তিন দিনের সরকারি সফরে গতকাল শনিবার বাংলাদেশে এসেছেন ব্রুনাই দারুসসালামের সুলতান। তার সফরের বিভিন্ন দিক নিয়ে বাংলাদেশ-ব্রুনাই দারুসসলামের সম্পর্ক নিয়ে দ্বিতীয় প্রতিবেদন ‘ঋণহীন রাষ্ট্র ব্রুনাই’।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাহাড়, অরণ্য ও সমুদ্রঘেরা দেশ ব্রুনাই দারুসাসালাম। বিশ্বের শীর্ষ ৫টি ধনী ও আধুনিক দেশের খেতাব রয়েছে তাদের। ২০১১ সালের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যানুযায়ী বিশ্বের ঋণহীণ দুটি দেশের একটি ব্রুনাই অপরটি ছিল লিবিয়া। যদিও মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যার পর পাল্টে গেছে লিবিয়ার সেই চিত্র। তবে ব্রুনাই এখনো ঋণহীন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের অন্যতম সম্পদ আর সমৃদ্ধির রাষ্ট্র।

ব্রুনাইয়ে তেল-গ্যাসের বিপুল মজুত

তেলের খনি আবিষ্কার ১৯২৯ সালে

১৯৪০-এ উত্তোলন ৬০ লাখ ব্যারেল

১৯৬৫ সালে এসে ১১৪৭০০ ব্যারেল

গ্যাস দিনে ২৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার

দেশটির জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ

দেশটির নাগরিকদের জন্য রয়েছে সকল প্রকার অত্যাধুনিক সেবা ও সুবিধা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সব দিকেই এগিয়ে আছে দেশটি। জনগণকে দিতে হয় না কোনো প্রকার কর। উল্টো সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ি, গাড়ি, চাকরি, ব্যবসায় বিনিয়োগ সবকিছু প্রদান করা হয়ে থাকে। দেশটি গড়তে লেগেছে দীর্ঘ সময়। যার শুরুটা করেন সুলতান তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দীন। তার নেতৃত্বে শুরু হয় আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের কাজ।

পূর্ব এশিয়ার বর্ণিও দ্বীপের উত্তর তীরে অবস্থিত ব্রুনাই দারুসসালাম। দেশটির উত্তরে দক্ষিণ চীন সাগর ও বাকি তিন দিকে মালয়েশিয়ার সারওয়াক প্রদেশের সীমানা। বর্ণিও দ্বীপের একমাত্র স্বাধীন দেশ ব্রুনাই। দ্বীপের বাকি অংশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অংশ। বর্ণিও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। ব্রুনাইয়ের আয়তন ২ হাজার ২২৬ বর্গমাইল। ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী জনসংখ্যা ৪ লাখ ৪২ হাজার। ২০১৯ সালের ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড আাইএমএফ এর শীর্ষ ১০টি ধনী দেশের তালিকায় ব্রুনাইয়ের স্থান পঞ্চম। দেশটির সরকারি ভাষা মালয়। অধিবাসীদের ৬৬ শতাংশ মালয়, ১০ ভাগ চীনা এবং ২৪ ভাগ অন্যান্য।

১৯৬৭ সালে হাসানাল বলকিয়াহর বাবা স্যার হাজি ওমর আলী সাইফুদ্দিন সিংহাসন ত্যাগ করার পর ১৯৬৮ সালের আগাস্টে তিনি ব্রুনেইয়ের সুলতান হিসেবে রাজমুকুট পরিধান করেন। তিনি একই সঙ্গে ব্রুনেইয়ের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। তা ছাড়া প্রতিরক্ষা, অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও তিনি পালন করছেন। তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন। শাসক হিসেবেও শীর্ষ সম্পদশালীদের অন্যতম। বিলাসবহুল জীবন এবং ইসলামী শরিয়া আইনে দেশ চালানোসহ নানা কারণে আলোচিত সমালোচিত এই সুলতানের জীবন। বিশ্বজুড়ে সর্বশেষ টিকে থাকা পূর্ণাঙ্গ রাজতন্ত্রগুলোর একটি এটি। ১৯৬৮ সালে সুলতান হওয়ার পর থেকে তার হাতেই সব নির্বাহী ক্ষমতা।

রাজতান্ত্রিক ইসলামিক শাসনে পরিচালিত দেশ ব্রুনেই একসময় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে দেশটি। একমাত্র মালয় রাজ্য হিসেবে ১৯৬৩ সালে ব্রুনেই ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাধ্যমে দেশটি মালয়েশিয়ার অংশ হবার জন্য গঠন করা ফেডারেশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরপর ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ। এরপর ১৯৮৪ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা পায় ব্রুনেই। কিন্তু ওই বছরই সুলতান দেশটির পার্লামেন্ট সাসপেন্ড করেন। এরপর ২০০৪ সালে সুলতান পার্লামেন্ট নতুন করে চালু করেন।

২০১৪ সালে পূর্ব এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ব্রুনেই ইসলামিক শরিয়া আইনে দেশ চালানোর ঘোষণা দেয়। দেশটির আইনে পরকীয়া প্রেমের শাস্তি পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড এবং চুরির সাজা হিসেবে হাত কেটে নেয়ার বিধান আছে। ১৯৯১ সালে তিনি দেশটিতে ‘মালয় মুসলিম মোনার্কি’ নামে নতুন এক রক্ষণশীল ভাবধারা চালু করেন, যার মাধ্যমে সম্রাটকে ধর্মের রক্ষাকারী বা রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে দেশ শাসন করলেও প্রজাদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদের কল্যাণে ছোট্ট একটি দেশ ব্রুনেইয়ের জনগণের জীবনযাত্রার মান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়। এ দেশে কোনো আয়কর দিতে হয় না সরকারকে। বরং বিভিন্ন সরকারি স্কিম বা কর্মসূচির অধীনে সুলতান নিয়মিত জনগণের মধ্যে জমি এবং বাড়িঘর বিতরণ করে থাকেন। এসব কারণে ব্রুনেইয়ের জনগণের কাছে সুলতান বেশ জনপ্রিয়।

বিলাসবহুল জীবন: সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্যও বেশ আলোচিত-সমালোচিত। এক সময় তিনি ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। এখন তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ছয়শো বছরের বেশি পুরনো রাজবংশের উত্তরাধিকারী সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ উত্তরাধিকার সূত্রেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেকগুলো বিলাসবহুল হোটেলের মালিক সুলতান। রয়েছে দেশে বিপুল ভূ-সম্পত্তিরও মালিকানা তার। সুলতানের দুইজন স্ত্রী এবং ১১ সন্তান।

ব্রুনাইয়ের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দেয় তেল আবিষ্কার। ১৯২৯ সালে ব্রুনাইয়ে তেলের খনি আবিষ্কার হয়। এরপর থেকে সম্পদের পাহাড় জমতে থাকে দেশটিতে তেল গ্যাসের আয় দিয়ে। সাড়ে চার লাখ জনসংখ্যার এ দেশটিতে ১৯৪০ সালে উৎপাদিত হয় ৬০ লাখ ব্যারেল তেল। ১৯৬৫ সালে দৈনিক উৎপাদিত হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ ব্যারেল তেল। আর বর্তমানে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ব্যারেল তেল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটি চতুর্থ বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। তেল ছাড়াও দেশটিতে প্রতিদিন গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার।

ধনী এ দেশ ব্রুনাইয়ের শাসকরা সকল নাগরিকের চিকিৎসা এবং আবাসনখাতে সহায়তা প্রদান করে থাকে। দেশটির প্রয়োজনীয় ৬০ ভাগ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ব্রুনাইয়ের প্রতি দুই জন নাগরিকের একজনের প্রাইভেট কার রয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ির থাকার হার বিশ্বে ব্রুনাই শীর্ষে।

ছোট এ দেশটিতে রয়েছে ১০০ মাইল দীর্ঘ উপকূল রেখা। দেশের পূর্ব অংশ নয়নাভিরাম পাহাড় ঘেরা। রাজধানী বন্দর সেরি বেগওয়ানও পাহাড় ঘেরা একটি শহর। দেশটির অধিকাংশ এলাকা রেইন ফরেস্টে ঘেরা। যে কেউ এ দেশ বা শহর ভ্রমণে যাবে সে দেশটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস করে রাজধানীতে। রাজধানী ছাড়া অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর হলো বন্দর নগরী মুয়ারা এবং তেল সমৃদ্ধ শহর সিয়ারা ও কুয়ালা বেলায়েত।

আধুনিক ব্রুনাইয়ের মূল রূপকার সুলতান তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দীন। তেলের বিপুল আয় দিয়ে ব্রুনাইয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা করেন সুলতান তৃতীয় ওমার আলী সাইফুদ্দীন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শিক্ষা, যোগাযোগ এবং অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়। নির্মাণ করা হয় বিমান বন্দর। ১৯৬২ সালে তিনি গ্রহণ করেন দ্বিতীয় উন্নয়ন প্রকল্প। ১৯৬৩ সালে আবিষ্কার হয় একটি বড় ধরনের তেল ক্ষেত্র। তেল এবং গ্যাস উত্তোলনের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়। নির্মাণ করা হয় গভীর সমুদ্রবন্দর। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাল্টে যায় দেশের সামগ্রিক চেহারা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন