এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় খ্যাত কবি হেলাল হাফিজ। মাত্র ২টি বই লিখে এমন জনপ্রিয়তা খুব কম কবির ভাগ্যেই জোটে। বাংলা ভাষার তুমুল জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের ৫৬টি কবিতা দিয়ে কবি বাংলা কবিতার জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। একটি মাত্র বইয়ের মাধ্যমে কাব্য সাম্রাজ্যে রাজত্ব করে আসা কবির কপালে বিরলপ্রজ তকমা জোটে। কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায় লেখক ইমরান মাহফুজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি হেলাল হাফিজ বলেন, প্রায় ১৩ দিন ধরে হাসপাতালে আছি। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। শারীরিক- মানসিক নানা জটিলতার সঙ্গে নিঃসঙ্গতা তো আছেই। এখন মনে হয়, এই জীবন দীর্ঘ হোক তা আর চাই না।’
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গ্লুকোমায় আক্রান্ত। পাশাপাশি কিডনি, ডায়াবেটিস ও স্নায়ু জটিলতার মতো নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছি। এতো সমস্যার ভেতর জীবন দীর্ঘ কীভাবে চাই? মাত্র ২টি কবিতার বই দিয়েই হেলাল হাফিজ জয় করেছেন অজস্র পাঠকের হৃদয়। বলা যায়, ‘ভালো লাগা’ একাকীত্বকে সঙ্গী করেই কেটে যাচ্ছে তার জীবন। নানাবিধ রোগে ভুগতে থাকা এই কবি এখন অনেকটা শয্যাশায়ী।
রিফাত হাসান এর লেখা হেলাল হাফিজের অজানা উপাখ্যান থেকে জানা যায়, হেলাল হাফিজের কবিতায় হেলেন নামের এক নারীর নিয়ে বেশ কিছু হৃদয়গ্রাহী কবিতা আছে। হেলেন ছিলেন তার প্রথম প্রেমিকা এবং হেলেনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যধিক সংবেদনশীল। হেলেন প্রসঙ্গ উঠলে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন এমনকি একসময়ে কান্নাকাটিও করতেন।
জানা যায় হেলাল হাফিজের স্কুলজীবনে হেলেনের সাথে প্রেম হয়েছিল। তারা ছিলেন প্রতিবেশী। দীর্ঘ প্রেমের পর দুই পরিবারে ঘটনাটি জানাজানি হয়। হেলেনের বাবা ছিলেন দারোগা আর হেলাল হাফিজের বাবা স্কুলশিক্ষক। হেলাল হাফিজের বাবা দারোগার মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে চাননি, এ নিয়ে দুই পরিবারে বিরোধ ঘটে এবং হেলাল হাফিজ হেলেনকে বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বললে হেলেনও নির্বিকার থাকেন। পরে হেলেনের বিয়ে হয় ঢাকার একটি সিনেমা হলের মালিকের সাথে। হেলেনের বিয়ে হয়ে যাবার পর হেলাল হাফিজ দশ-পনেরো দিন কারো সাথে কোনো ধরনের কথা বলেননি। শেষ পর্যন্ত আর বিয়ে করেননি হেলাল হাফিজ।
একবুক কষ্ট চেপে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান হেলাল হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়াও করেছেন। আলাদা বৈশিষ্ট্য আর সহজবোধ্যতার কারণে তার কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। হেলেনের স্বামী বইমেলা ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটিও কিনে বাসায় গেলে হেলেন যখন দেখতে পেলেন বইটির পুরোটা জুড়ে আছে হেলালের কষ্টের ইতিবৃত্ত। তখন ক্রমশ তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
হেলেনের স্বামী দেশে-বিদেশে হেলেনের উচ্চচিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও হেলেন সুস্থ হননি। একপর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে হেলেন তালাকপ্রাপ্ত হন। হেলেন এখন নেত্রকোনায় আছেন। এখন তিনি বদ্ধ উন্মাদ। হেলেনকে এখন শেকল পরিয়ে ঘরে বেঁধে রাখতে হয়, ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় ওষুধ খাইয়ে; অন্যথায় তিনি ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন। বিয়ে না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বলেন, ‘আমি যে কাউকে বিয়ে করিনি, তা নয়; বরং আমাকেই কেউ বিয়ে করেনি!
হেলাল হাফিজের একেকটি কবিতা একেকটি বঞ্চনার ফসল। বঞ্চনাই কবির কবিতাকে করেছে সমৃদ্ধ। বাংলা কবিতার প্রেম ও বিরহের কবি হেলাল হাফিজ ৩৪ বছর পর নিজের গড়া রেকর্ড ভাঙলেন। একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ নিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কবি ৩৪ বছর পর ৩৪টি কবিতা দিয়ে প্রকাশ করছেন দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এই বই সম্পর্কে কবির দ্বিতীয় আবাস জাতীয় প্রেসক্লাবের মিডিয়া লাউঞ্জে বার্তা২৪.কমকে প্রদত্ত একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রেম-বিরহ-দ্রোহের রাজকুমার হেলাল হাফিজ বললেন, সম্প্রতি আমার জন্মদিনে অনুরাগীদের কথা দিয়েছিলাম, বেঁচে থাকলে আরও একটি বই উপহার দিয়ে যাব। এই বই সেই প্রতিশ্রুত বই।
হেলাল হাফিজ বলেন, এই বই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তির ফসল। প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই মনের কোণে উঁকি দিয়েছে কবিতার নানা লাইন। সেগুলো অণু কবিতা হিসেবে লিখে ফেলেছি। কবি বলেন, এ যুগে বড় কবিতা পড়ার সময় মানুষের কম। অণু কবিতাগুলো ফেসবুকে প্রকাশিত কাব্যানুরাগীদের দৃষ্টি কাড়ে। তিনি বলেন, বইটিতে মোট ৩৫টি কবিতা স্থান পেয়েছে। ‘পিতার পত্র’ নামের কবিতাটি মূলত আমার বাবার লেখা একটি চিঠির লাইন। কবিতাটিকে ইনভারটেড কমার মধ্যে এখানে তুলে দিয়েছি। আমার নিজস্ব কবিতা ৩৪টি। অন্তত দুইশ’ কবিতা থেকে বাছাই করে শেষাবধি ৩৪টি কবিতা দিয়ে এই বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করি। বাকি কবিতাগুলো আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই।
পিতার কবিতা বইয়ে স্থান প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে কবি বলেন, আমার ভরজীবনের যে দুঃখ, কষ্ট। তা পিতার থেকেই পাওয়া। তিনি বলেছিলেন- আমি যে দুঃখ কষ্ট দিয়ে গেলাম, তা লালন করো। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ক্ষুদ্র হলেও বড় ব্যঞ্জণাময়। যেমন- ‘কোনোদিন, আচমকা একদিন/ ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-/ ‘চলো, যেদিক দু’চোখ যায় চলে যাই’, / যাবে? (অভিসার), ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’,/ মন না দিলে/ ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা’ (প্রতিদান)। ‘যদি যেতে চাও, যাও,/ আমি পথ হবো চরণেরর তলে/ না ছুঁয়ে তোমাকে ছোঁব/ ফেরাবো না, পোড়াবোই হিমেল অনলে’ (পথ)।
আজন্ম মানুস আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে’/ মানুষের কাছে এও তো আমার এক ধরনের ঋণ। / এমনই কপাল আমার/ অপরিশোধ্য এই ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে’ (কবিসূত্র)। ‘হয় তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি/ নয় তো গিয়েছি হেরে,/ থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা/ কে কাকে গেলাম ছেড়ে’ (জটিল জ্যামিতি)। ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো’ (সতীন)। ‘সূতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই/ আমি তো কাঙাল ঘুড়ি,/ বৈরী বাতাসে কী আশ্চর্য/ একা একা আজও উড়ি!’(ঘুড়ি)। ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’ (ওড়না)। ‘বিনা জলে, বিনা সমীরণে/ দেখো, দেখো কতো ঢেউ/ কটিদেশে, মনে!’(ঢেউ)।
কেন হোটেলে থাকেন ইমরান মাহফুজের এমন প্রশ্নের জবাবে হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, ‘আমি হোটেলজীবন এনজয় করি। নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা আমার ভালো লাগে। একাকীত্বের এই বেদনাকে আমি উপভোগ করি।’
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ