এমন উদ্যোগ টায়ারের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য: প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান
তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের এই দুর্মূল্যের বাজারে নতুন এক আশার আলো জাগিয়েছেন নীলফামারীর এক উদ্যোক্তা তরুণ তোফাজ্জল। তিনি বাস, ট্রাক, বাই সাইকেল, রিকশা ভ্যান, মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের ফেলে দেয়া পরিত্যক্ত টায়ার থেকে মূল্যবান জ্বালানি তেল উৎপাদন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেলের যোগান ও অপর দিকে পরিবেশ দূষণকারী যানবাহনের পরিত্যক্ত টায়ার ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এতে বাড়ছে বিনিয়োগ সম্ভাবনাও।
গত বৃহস্পতিবার তোফাজ্জলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেকার যুবকদের উদ্যোক্তা হবার জন্য আহবান জানিয়েছেন। আসলে চাকরির পেছনে না ছুটে সত্যিকারের একজন উদ্যোক্তা পাল্টে দিতে পারে উন্নয়নের চিত্র। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে উদ্যোক্তার পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি পরিত্যাক্ত টায়ার থেকে রীতিমতো টায়ার অয়েল অ্যাসফল্ট তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেছেন। বিভিন্ন ভারী শিল্পকারখানার জ্বালানি হিসেবে টায়ার থেকে তৈরি এই ওয়েল কাজে লাগানো হচ্ছে।
টায়ার থেকে উৎপাদিত এই ওয়েল দিয়ে চলছে সড়ক ও মহাসড়কের কার্পেটিং নির্মাণের পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে। একইসঙ্গে ছাপাখানাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত মূল্যবান কালি কার্ব তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও টায়ার থেকে বের হওয়া তারগুলো চলে যাচ্ছে ফাউন্ড্রি শিল্পে এবং স্টিল রিরোলিং মিলে। সেখানে তৈরি হচ্ছে মূল্যবান রড। একইসঙ্গে টায়ার থেকে এসব মূল্যবান উপাদান পাওয়ায় এই শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পূর্বদলিরামপুর এলাকায় তোফাজ্জল বার্নিং ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের এই কারখানটি নতুন প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ বর্জ ও পরিবেশ দূষণমুক্তভাবে চলছে। প্রায় এক একর জমির ওপর নির্মিত নতুন এই কারখানাটি প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ লিটার জ্বালানি তেল উৎপাদিত হচ্ছে বলে জানালেন কারখানার উদ্যোক্তা ।
তোফাজ্জলের তথ্যমতে, বাজারে এখন ডিজেল ১১৪ টাকা লিটার। ফার্নেস ওয়েল ৭০ টাকা লিটার। টায়ার থেকে উৎপাদিত তেল তিনি লিটার প্রতি মাত্র ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন। সাশ্রয়ে পাওয়া এই জ্বালানি তেলে যেকোনো শিল্প উদ্যোক্তা ব্যাপক লাভবান হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এই শিল্পে সরকার সহযোগিতা করলে গোটা দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। কারণ প্রতিদিন বিদেশ থেকে ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল আমদানিতে সরকারের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। তাছাড়া ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েলে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশেই যদি টায়ার থেকে তেল উৎপাদনের এই শিল্পকে বিকশিত করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে না, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। সেইসঙ্গে সচল হবে দেশের অনেক বন্ধ হয়ে থাকা কারখানা ও শক্তিশালী হবে দুর্বল ভারী শিল্প কারখানা।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে রয়েছে শিল্পপতি রাজ কুমার পোদ্দারের মালিকানাধীন নোয়াহ রয়েলেক্স মেটাল ইন্ড্রাস্ট্রি। এখানে তৈরি হয় প্রেশার কুকার, গ্যাসের চুলা ও তৈজসপত্র। যা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাড়াও বিদেশে পাঠানো হয়ে থাকে। এই শিল্পকারখানার মালিক জানালেন পণ্য উৎপাদন করতে আমদানি করতে হতো ফার্নেস তেল। বিশেষ করে অ্যালুমিনিয়াম পণ্য তৈরিতে ফার্নেস তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু এখন জ্বালানি খরচে সাশ্রয় নিয়ে এসেছে নীলফামারীর উদ্যোক্তা তোফাজ্জল। তার ওখানকার উৎপাদিত টায়াল তেল কম মূল্যে পাচ্ছি আমি। তাই এখন উৎপাদন খরচও কমে এসেছে।
নীলফামারীর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী সফিকুল আলম জানালেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোক্তা হবার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তোফাজ্জল আজ বদলে ফেলেছে নীলফামারীর উন্নয়নের আরেকটি চিত্র। তাকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। টায়ার থেকে তেল এ জেলার শিল্পকারখানায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
কিশোরীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসানের কাছে এই তেল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সড়কের কাপের্টিং কাজে হপার মেশিনের মাধ্যমে পাথর এবং বিটুমিন গরম করে মিশ্রণ করে কার্পেটিং করতে হয়। হপার মেশিনে কার্পেটিংয়ের মালামালের মিশ্রণের সময় জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের প্রয়োজন হতো। সেখানে ডিজেলের পরিবর্তে টায়ার অয়েল কিংবা ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করলে নির্মাণ ব্যয় কম হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান বলেন, এটা খুবই সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। কেননা বাতিল হওয়া টায়ারগুলো যদি ধ্বংস করা না হয় তাহলে এগুলো একদিকে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্বক প্রভাব ফেলবে। তাই পরিত্যাক্ত টায়ার থেকে এই তেল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।