ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবং মা ইলিশ শিকার নিয়ন্ত্রণে আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহণ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, ইলিশের উৎপাদনে একসময় খারাপ অবস্থা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, ইলিশ সমৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট গবেষণা ও বর্তমান সরকারের গৃহিত ব্যবস্থাপনায় ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গত ১২ বছরে ইলিশ আহরণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২২ বাস্তবায়ন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী একথা জানান।
মন্ত্রী বলেন, ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র মানুষ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। ইলিশের উৎপাদন ব্যাপক আকারে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অত্যন্ত সুস্বাদু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও আবেগের মাছ ইলিশ। ইলিশের জিআই সনদ বাংলাদেশের। পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশ আমাদের দেশে উৎপাদন হয়। সরকারের কঠোর ব্যবস্থাপনা, ইলিশের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি, মা ইলিশ ধরতে না দেওয়া, জাটকা আহরণ বন্ধ রাখা এবং ইলিশ যেখানে ডিম দেয় সে জায়গায় উপযোগী পরিবেশ রক্ষার ফলে ইলিশের উৎপাদন এভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখাকালে ইলিশ আহরণে সম্পৃক্ত মৎসীজীবীদের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, সেজন্য তাদের সরকার চাল দেয়, বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সহযোগিতা দেয়। মা ইলিশ অথবা ছোট ছোট ইলিশ ধরলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না। সেক্ষেত্রে ইলিশ আহরণকারী জেলেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দেশের মানুষ ইলিশ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে, রপ্তানি পণ্যের ক্ষতি হবে এবং নিষেধাজ্ঞার সময় ইলিশ ধরতে যাওয়া অসাধু ব্যক্তিরা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য স্থানীয়ভাবে সচেতন করা, বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়াসহ নানাভাবে সরকার জেলেদের মা ইলিশ ও জাটকা আহরণ থেকে বিরত রাখে।
মন্ত্রী বলেন, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কেউ মাছ আহরণ করে কী না সেটা বিমানবাহিনীর মাধ্যমে আকাশপথে মনিটর করা হবে। নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও মৎস্য অধিদপ্তর সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। নৌ পাহারা, আকাশ পথে পাহারা ও স্থলপথে পাহারা দেওয়া হবে। মা ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে কোথাও কোথাও বরফকল বন্ধ রাখা হবে। নিষেধাজ্ঞার সময় যারা আইন অমান্যের অপরাধ করবে তাদের তাৎক্ষণিক সাজা প্রদানে মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া অবৈধভাবে মাছ আহরণ করা যানবাহন জব্দ করা, প্রয়োজনে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা, মা ইলিশ ধরা থেকে বিরত রাখতে মৎসীজীবীদের উৎসাহিত করাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মা ইলিশ সংরক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
সাংবাদিকদের মন্ত্রী আরও জানান, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সহজ-সরল জেলেদের যানবাহনে নিয়ে বন্ধকালে মাছ ধরার চেষ্টা করে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। যারা অবৈধ জাল তৈরি করে আহরণ বন্ধকালে জাটকা অথবা মা ইলিশ ধরে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেয়। এমনকি জাল তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে বেআইনি জাল উদ্ধার করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত ইলিশ রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৩৫২ মেট্রিক টন। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এই মুহূর্তে দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইলিশ বৃদ্ধি না পেলে আমরা রপ্তানি করে এ বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারতাম না।
মন্ত্রী বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন, নদীর স্রোত ও পরিবেশের সঙ্গে ইলিশ সম্পৃক্ত। বৈরী পরিবেশ, অসাধুভাবে বালু উত্তোলন, নদী ভাঙ্গন, নদীর পানি দূষণসহ নানা কারণে মা ইলিশের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে বিধায় বর্তমানে ইলিশের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে। এখন ছোট নদীসহ অনেক দুর্লভ জায়গায় ইলিশ পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা মৎস্যজীবীদের অতীতে পরিবার প্রতি ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হতো। এ বছর এটি ২৫ কেজিতে উন্নীত করা হয়েছে। এবার দেশের ৩৭ জেলার ১৫৫টি উপজেলায় ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৭ টি জেলে পরিবারকে ১৩ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মা ইলিশ আহরণ বন্ধকালে আমাদের জলসীমায় নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌপুলিশসহ মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করে। মিয়ানমার অথবা অন্য কোন দেশের কেউ এসে আমাদের ভৌগলিক এলাকায় মৎস্য আহরণের কোন সুযোগ নেই। যদি কেউ লুকিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে চায় আমরা তাদের গ্রেফতার করবো। এ ব্যাপারে আমরা কঠোরভাবে নজরদারি করছি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ, অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল কাইয়ূম, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আনন্দবাজার/কআ