- আমদানীর নামে অর্থ পাচার, অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ খরচ বন্ধ করতে না পারলে রিজার্ভ সংকট বাড়বে: অর্থনীতিবিদ ড. আনু মোহাম্মদ
- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না: ফজলে শামীম এহসান, সহসভাপতি, বিকেএমইএ
- ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বিকল্প খুঁজে দ্রুত পোশাক পণ্য রপ্তানি করা হবে: শহিদুল্লাহ আজিম, সহসভাপতি, বিজিএমইএ
বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি, বাড়ছে ডলারের দাম। কমছে রেমিট্যান্স। আশঙ্কাজনকভাবে কমছে রিজার্ভ। সংকটে পড়ছে অর্থনীতি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। আবার আশানুরূপ রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। এতে রিজার্ভের সংকট বাড়ছে। এখনই বাণিজ্য ঘাটতি না কমালে এবং রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে আশংকাজনক পরিস্থিতিতে গিয়ে দাঁড়াবে সংকট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে ডলারের ঘাটতি থাকায় রিজার্ভ থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে। ফলে রিজার্ভ কমে আসছে। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। প্রবাসী আয় কমেছে, তবে সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৪৫৫ কোটি ডলার বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে চলতি হিসাব ও সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে রপ্তানি হয়েছে ৮১৩ কোটি ডলার। যা তার আগের অর্থবছরের এর একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ২৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ সময় আমদানি হয়েছে এক হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় থেকে আমদানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪২৮ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরে প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ঘাটতির (ঋণাত্মক) অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৪১ কোটি ডলার। জুলাই-আগস্ট সামগ্রিক লেনদেনে (ওভার অল ব্যালান্সেস) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি ডলার, যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ২২১ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। আলোচ্য সময়ে ৭৮ কোটি ডলার বিনিযোগ করেছে বৈদেশিক উদ্যোক্তারা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ডলার।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবীদ ড. আহসান এইচ মনসুর দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানী এখনো বাড়তির দিকে। যেকারণে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বাড়াতে হলে রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করতেই হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমাটা স্বাভাবিক। এখন যদি আমদানী কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে বাজারে বিসৃঙ্খলা দেখা দিবে। সবার আগে চাহিদা কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে আমদানী কমানো সম্ভব। এতে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবে না। রিজার্ভ থেকে তুলনামূলক ডলার কম খরচ হবে। চাহিদা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকার মধ্যে। এ দামে চাহিদা কমানো যাবে না। চাহিদা কমাতে হলে ডলারের দাম আরো বাড়াতে হবে। তাহলেই রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকবে।
এদিকে প্রবাসী আয়ে এসেছে বড় ধাক্কা। গত ৭ মাসে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে। এ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১০৮ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ ১৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। গত ৭ মাসের মধ্যে এটিই প্রবাসীদের পাঠানো সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যমতে, সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মোট ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার বা প্রায় ১.৫৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের (২০২১ সালের সেপ্টেম্বর) একই সময়ের চেয়ে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার কম। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার বা প্রায় ১.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
আলোচিত সময়ে (সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকের মাধ্যমে ২৪ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। একই সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬১ লাখ ডলার এবং বিশেষায়িত এক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ৪১ ডলার।
অর্থনীতিবীদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. আনু মোহাম্মদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। কিন্তু দেশের টাকা চুরি করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। আমদানির নামে বিদেশে প্রচুর টাকা যাচ্ছে। সেগুলো বন্ধ করতে পারেনি। সরকার এবিষয়ে কিছুই করছে না। অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ খরচ করলে রিজার্ভ আরো বেশি সংকটে পড়বে। এসব খাতে খরচ কমানো গেলে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতির জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হলো বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। এ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানির বিপরীতে আয় হয়েছে ৩৯০ কোটি ডলার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪১৬ কোটি ৫৪ লাখ ৫ ডলার। সেই হিসেবে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে।
ইপিবির সেক্টরওয়াইজ ডাটা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে ৩১৬ কোটি ১৬ লাখ ৭ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৩৪১ কোটি ৮৮ লাখ ৪ হাজার ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে। ওভেন ও নিটওয়্যার উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানিই কমেছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ২৮৮ কোটি ৭২ লাখ ২ হাজার ডলার, যা ২০২০ সালের জুলাই মাসের চেয়ে ১১ দশমিক ২ শতাংশ কম। সেই হিসাবে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৩ মাস পর রপ্তানি আয় কমলো।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বিকল্প খুঁজে বের করা হচ্ছে। দ্রুত সেসব দেশে পোশাক পণ্য রপ্তানি করা হবে। বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, পোশাক রপ্তানি যে কমবে, সেটা তো আগে থেকেই আমরা বলে আসছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। তারা অন্যান্য খরচের সঙ্গে পোশাক পরিধানের খরচও কমিয়ে দিয়েছে। সেই কারণেই আমাদের রপ্তানি আয় কমছে। যতদিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে, ততদিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আমার মনে হয় না।