ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লীলা নাগের ঋণ শোধ

লীলা নাগের ঋণ শোধ

ভারতীয় উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের এক বিপ্লবীর নাম লীলা নাগ। অসম সিভিল সার্ভিসের সদস্য গীরিশ চন্দ্র নাগ ও শিক্ষিতা গৃহবধু কুঞ্জলতা নাগের কোল আলো করে ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর এদিনে বিপ্লবের স্ফুরণ ঘটিয়ে আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্ম নেন এ বিদূষী নারী। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত থাকে তাঁর চিন্তা চেতনা, কর্ম, সাধনা আর সংগ্রামে। এ মহিয়সী নারীর জীবনদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল প্রগতিশীল ধারায় নারী মুক্তির আন্দোলন ও সমানাধিকার বাস্তবায়ন। জীবদ্দশায় তিনি নারীদের এ পথে শৃঙ্খল ভেঙে নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর পুরো পরিবার দেশপ্রেমে নিবেদিত ছিলেন।

লীলা নাগের বিদূষী মা শৈশব থেকে কন্যাকে শিখিয়েছিলেন যে, ত্যাগের মধ্য দিয়েই সেবা করতে হয়। মায়ের এ শিক্ষা কন্যাকে মহৎ জীবনের সকল স্তরে প্রলুব্ধ করতো। পিতা ও পিতামহ সরকারি চাকরিজীবি হওয়া সত্ত্বেও লীলী নাগ শৈশব থেকেই দেখেছেন, বাড়িতে বিলেতি কাপড় বর্জন এবং বাড়ির সবার জন্য মোটা কাপড় বরাদ্দ হয়েছে। আরো দেখেছেন, বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসীর দিনে অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এ পরিবার ভারতের প্রথম শহীদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।

কিশোরী লীলা নাগকে তাঁর মা-বাবা, পিতামহ ও মাতামহ শোনাতেন দেশ-বিদেশের কাহিনি এবং নানা দেশের বিপ্লবীদের গল্প। এসব গল্প তাঁর কিশোরী মনে গভীর ছাপ ফেলতো। এভাবেই একটি আদর্শ পরিবারের শিক্ষা লীলা নাগকে বিপ্লবীর ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং পরিবারের উদার, আধুনিক চিন্তাধারা ও মানসিকতা তাঁকে করে তুলেছিল নির্ভিক, তেজস্বী ও আপোষহীন যোদ্ধা। এ বিদূষী নারী ছিলেন একাধারে দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক কর্মী, পত্রিকার সফল সম্পাদক, ক্রীড়াবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

কলকাতা বেথুন কলেজ থেকে ১৯২১ সালে ইংরেজি অনার্স পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকার করে ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। এরপর ১৯২৩ সালে প্রথম শিক্ষার্থী ও একমাত্র ছাত্রী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ ডিগ্রী লাভ করে নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেন। তিনিই প্রথম রানী ভিক্টোরিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে কুর্ণিশ করার তীব্র বিরোধীতা করেন।

নারী জাগরণের অগ্রদূত লীলা নাগ ‘নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটি’, ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’, ‘উত্তরবঙ্গ বন্যা ত্রাণ সমিতি’সহ অনেক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। এমএ পাশের পর লীলা নাগ তাঁর ১২ জন সঙ্গী নিয়ে ‘দীপালি সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় তিনি ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ও শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। নারী মুক্তির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘দীপালি সংঘ’র মাধ্যমে তিনি মেয়েদের হাতের কাজ, কুটির শিল্প ও কারিগরী কাজের ব্যবস্থা করেন। তাঁর স্থাপিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম ইংরেজি বিদ্যালয় ‘দীপালি স্কুল’ যার বর্তমান নাম কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল, ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ যার বর্তমান নাম শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় এবং আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয় অন্যতম।

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা শ্রদ্ধেয় দীপু মণি এবং মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মহাদয়ের কাছে বিনীত অনুরোধ, লীলা নাগের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘দীপালি স্কুল’ ও ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ দু’জন মহৎ ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হলেও এখনো আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের নাম কারো নামে করা হয়নি। তাই আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের নাম ‘আরমানীটোলা লীলা নাগ বালিকা বিদ্যালয়’ করার দাবি জানাচ্ছি। তাহলে অন্তত এ মহিয়সী নারীর কিছুটা ঋণ শোধ করা হবে ও বর্তমান প্রজন্মও এ বিদূষী এবং বিপ্লবী নারী সম্পর্কে জানতে পারবে।

লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন