ঢাকের বোল, কাঁসর ঘণ্টা ও শাখের ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠার অপেক্ষায় সারাদেশ। পঞ্জিকা মতে আগামীকাল শনিবার (১-৫ অক্টোর পর্যন্ত) ষষ্টী পূজার মধ্য দিয়ে মহাধুমধামে শুরু হতে যাচ্ছে পাঁচ দিনব্যাপী সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় মহা-উৎসব শারদীয় দূর্গা পূজা। বছরঘুরে দেবীর আগমনী বার্তায় উৎসবের আমেজ এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে।
ইতিমধ্যে দেশের সবগুলো মন্দির ও মন্ডপে প্রতিমা তৈরি, স্থাপন ও আলোকসজ্জাসহ সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভোর থেকে মন্দিরে মন্দিরে বেজে উঠবে কাঁসর ঘণ্টা। ভক্ত অনুরাগীরাও পূজা অর্চনায় হাজির হবেন মন্দিরে মন্দিরে। চলতি বছর সারাদেশে ৩২ হাজার ২৬৮টি মন্দির ও মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামী ৫ অক্টোবর দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই মহা উৎসবের।
শারদীয় দূর্গোৎসবের সার্বিক প্রস্তুতি প্রসঙ্গে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সরকারে পক্ষ থেকে সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সুধীসমাজসহ সকল মানুষকে নিয়ে ভালোভাবে পূজা উৎসব পালনের প্রত্যাশা করছি। আশাকরি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে সার্বিকভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন পূজা উৎসব যেন ভালোভাবে পালন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে। আমরাও নির্বিঘ্নে পূজা উদ্যাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেই মোতাবেক সিসি ক্যামেরাসহ নানান ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। তাতে করে মনে হয় না কোন ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। সনাতন ধর্মালম্বীরা নিরাপদে শারদীয় দূর্গা মহোৎসব পালন করতে পারবে।
পূজার প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বাবু চন্দ্রনাথ পোদ্দার দৈনিক আনন্দবাজারকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে পূজায় সংকট যাচ্ছে এটা সত্যি, তবে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় সকল মানুষের অংশগ্রহণে সার্বিক দিক নিয়ে আশ্বান্বিত করেছে এবারের দূর্গোৎসব। আমরাও আশাকরি এবার পূজাতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না।
হিন্দুদের মধ্যে একটি ভীতি কাজ করে পূজা দেখতে যাওয়ার বিষয়ে এমন প্রশ্নের জবাবে বাবু চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, অকর্ম যারা করে তারা ছিল, আছে এবং থাকবে। তাদের জন্য ভীত হওয়ার কিছু নেই। এবার সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদানে কোন ধরনের প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। আর আমরা নিজেরাও সচেতন ও সজাগ থাকবো এবং যেকোন অপ্রীতিকর, সন্দেহজনক কিছু দেখলে ৯৯৯ সহযোগিতা নেয়া পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ সারাদেশকে ১২টি অঞ্চলে বিভক্ত করে (প্রতিটি অঞ্চলে ৫-৬টি জেলা নিয়ে গঠিত) পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। আসলে শঙ্কা নিয়ে তো আনন্দ উৎসবে বসে থাকা যায় না। তাই নিজেদেরও সচেতন হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে নির্বিগ্নে পূজা দেখে বাড়ি ফিরতে পারি সেদিকেও সজাগ থাকতে হবে।
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও ভাবছে পূজায় সবকিছু ভালোভাবে হবে। নিজেদের ঘরেও অনেক সময় আশঙ্কা থাকে। সেজন্য মানুষের একটা প্রস্তুতি থাকে। ব্যক্তিগত কাজে যাওয়ার সময়ও প্রস্তুতি থাকে। আমাদেরও সেই ধরনের প্রস্তুতি আছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ও সচেতন থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের পক্ষ থেকে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। পূজা উৎসব ভালোভাবে করতে পারলে দেশ ও জনগণ সকলের জন্যই মঙ্গল।
বাবু চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবের সঙ্গে দেখা করে গত বছরের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে আওয়ামলী লীগসহ সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হলে তিনি সার্বিকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন আওয়ামী লীগের লোকজন মন্দির-মন্ডপে পাহারা দিবে। আমরা সব সময় যেন আশাকরি সকলকে নিয়েই উৎসব পালন করতে পারবো। তা ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সার্বিক বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তারাও তথা হিন্দুসম্প্রদায়সহ সকল দেশবাসীকে আশ^স্ত করেছে এবার দূর্গোৎসবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই। তারপরও সবাইকে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
মহানগর পূজা উদ্যান পরিষদের সহ-সভাপতি বাবু নির্মল কুমার চ্যাটার্জী দৈনিক আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, মা হলো দেশের মতো। মাকে ভালোবাসা আর দেশকে ভালোবাসা সমান। যারা দেশকে ভালোবাসে না তারা মাকেও ভালোবাসে না। তাদের তো দেশে থাকারই অধিকার নেই। দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কৃষক-শ্রমিক, রাজনীতিবিদসহ সকল শ্রেণির মানুষের প্রয়োজন মাকে ভালোবাসে। শারদীয় দূর্গা উৎসব শুধু হিন্দুদের নয় এটি আপামর জনসাধারণের। দল-মত নির্বিশেষে সবাই মিলে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে দেশে। আশাকরি এবারো তাই হবে। এখানে কোন অশুভশক্তি আঘাত আনতে পারবে না। কারণ মার আগমনই হচ্ছে অশুভশক্তিকে বিনাশ করে শুভশক্তির প্রতিষ্ঠা করা।
বাবু নির্মল কুমার চ্যাটার্জী বলেন, কোন ধরনের নিরাপত্তার আশঙ্কা করছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার দেশে ৩২ হাজার ২৬৮টি মন্দির ও মন্ডপে পূজা হচ্ছে। সরকার নিরাপত্তা দিচ্ছে। সাধারণ মানুষও সজাগ আছে। আশাকরি কোন সমস্যা বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে না। তারপরও সচেতন থাকতে হবে। কারণ ৭১ এর ঘাতকরা এখনো উৎপেতে থাকবে। আমাদের সচেতন থাকা দরকার।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন এদেশ সকলের। পূজা শুধু হিন্দুদের নয় বরং হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান তথা সমগ্র বাঙালির। আর বাঙালি অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সকলেই প্রত্যেকের উৎসবে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে সহযোগিতা করে থাকি।
বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দিপালী চক্রবর্তী দৈনিক আনন্দবাজারকে লিখিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর-ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই শ্লোগান নিয়ে সারাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপুজা শুরু হচ্ছে। গত কয়েক বছর করোনা মহামারীর কারণে সারাদেশে পূজার পরিবেশ অন্যরকম ছিল। এবারো সরকারি নির্দেশনা মেনেই সারাদেশে নির্বিঘ্নে দূর্গা পূজা হবে বলে আমরা আশা করছি। এ বছর দেবীর আগমন ও প্রস্থান দুইই শুভ বার্তা বহন করে। আমাদের প্রার্থনা থাকবে-শুভ শক্তির আরাধ্য দেবী মানুষের অসুররুপী পশুত্বের বিনাশ ঘটিয়ে মনুষত্বের উত্তরণ ঘটাবে।
তিনি লিখেন, গত বছর কিছু সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশে সাম্প্রদায়িক নাশকতা সৃষ্টি করে অরাজক পরিস্থিতি তৈরীর চেষ্টা করে দেশের ভাবমুর্তি নষ্ট করার অপষ্টো করছে। এবার আমরা মনে করি সারাদেশে নিরাপদে পূজা করতে পারব। বাকী বিষয় প্রশাসন দেখবে। আমরা প্রশাসনের সাথে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। আশা করব শুধু প্রশাসনই নয় রাজনৈতিক সংগঠনও এগিয়ে আসবে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নাশকতা ঠেকাতে দলকে মাঠে থাকতে বলেছেন।
দিপালী চক্রবর্তী বলেন, সবশেষে বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ সম্প্রীতির বাংলাদেশ, এ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তার তনয়া ক্ষমতায়, তিনি যেভাবে জঙ্গি দমন, করোনা মহামারী সামলানো, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টান্ত রাখছেন তেমনি সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে কঠোর হাতে দমন করে এ দেশ সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবেন। আর যেন প্রশাসনের সহযোগিতায় কোন ধর্মীয় উৎসব পালন করতে না হয়, সবার মনে শুভ চেতনার উদয় হোক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হোক তারই সুযোগ্যকন্যার হাতে।