চার বছর পর প্রবৃদ্ধি ছাড়ালো ১৪ শতাংশ
করোনা সংকট কাটিয়ে ওঠার পরপর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে আমদানী। এতে খরচ করতে হয়েছে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্র ডলার। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এতে কমতে শুরু করে রিজার্ভ। করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া ব্যবসা দাঁড় করাতে বেশির ভাগ মানুষ ঝুঁকছে ঋণের দিকে। এতে বেসরকারিখাতে বাড়ছে ঋণ প্রবাহ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার পরিবর্তন না করায় ঋণের প্রবাহ বাড়ছে।
বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর করছে মুদ্রানীতি। বাংলাদেশে আগস্ট মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে, যা চার বছরের সর্বোচ্চ। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও, ক্রেডিট বৃদ্ধির কারণে পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ছে। আগস্টে ক্রেডিট প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশে পৌঁছেছে যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত ১৪ দশমিক ১ শতাংশের আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রাইভেট সেক্টের ক্রেডিট প্রবাহ কিছুটা কমেছে। তবে ব্যাংক ঋণের সুদহার পরিবর্তন না করায় ঋণের প্রবাহ বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই হার আরও বেশি হওয়া উচিত। সামগ্রিকভাবে, পাঁচ মাসের তীব্র বৃদ্ধির পর জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ০.০৮ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, জুন থেকে এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমেছে ০.১৮ শতাংশ পয়েন্ট।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় আগামী মাসে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে বলে আশা করছে সরকার। ডলারের দাম কমবে বলে আশা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে ডলারের মুল্য ছিল ৮৫ টাকা। এরপর থেকে দেশের আমদানি বাড়তে থাকায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু হয়। নিয়মিত ডলার বিক্রির কারণে কমতে থাকে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ। এছাড়া চলতি বছরে ৯ জানুয়ারি ডলারের দাম এক টাকা বেড়ে ৮৬ টাকা হয়।
চলতি বছরে এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট আরও বাড়তে থাকে যার ফলে দামও বাড়তে থাকে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি আমদানি বাবদ প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৬ টাকা। তবে ব্যাংক টু ব্যাংক ডলারের রেট সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা ৩৫ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতির বিবৃতি অনুসারে, অর্থ প্রবাহকে শক্ত করার অংশ হিসেবে বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধির সীমা ২০২২ অর্থবছরের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০২৩ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে টাকার সাপ্লাই কমাতে হবে। মানুষের হাতের টাকার সাপ্লাই বাড়তে থাকলে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। এখন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে তবে এটা যদি উৎপাদন খাতে ব্যয় হয় তাহলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পরবে না, কারণ উৎপাদন বাড়লে পণ্য মানুষের নাগালে থাকবে তখন মূল্যস্ফীতি কমতে থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতে গত জুন মাসে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে জুলাইতে এসে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যার ফলে দেখা গেছে বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর অ্যাকসেস লিকুইডিটি কমছে।
গত অর্থবছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে বিদায়ী অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এছাড়া চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ৩ বিলিয়নের বেশি বিক্রির ফলে গত ২১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬.৯৭ বিলিয়ন ডলার।
বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানির তুলনায় আমদানির ব্যয় ও পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে দেশের ইতিহাসে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিও সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।