ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সার্থক গদ্যকার

সার্থক গদ্যকার

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন উনবিংশ শতকের একজন সংস্কৃত পণ্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক। বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য ‘হিন্দু ল কমিটি’ ১৮৩৯ সালে তাঁকে  বিদ্যাসাগর উপাধি প্রদান করেন, যা ১৯৪১ সালে সংস্কৃত কলেজের প্রশংসাপত্রে উল্লেখ করা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল ভগবতী দেবী। তাঁর পারিবারিক পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়, সে হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বাক্ষর করতেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা’ নামে।

১৮২৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখম পাঁচ বছর তখন তাকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তার আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। এরপরও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার হিসেবে মনে করা হয় । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পূর্বে যে সকল গদ্য রচিত হয়েছিল, সেইসব গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রুবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, ছন্দোময় এবং গতিশীল। আর এসব কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার বলা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা আধুনিক গদ‍্যের জনক। বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কি রকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলিতে। বিদ্যাসাগর গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন কলেজের পাঠ্যক্রমে। পূর্বে ব্যাকরণ এবং বীজগণিত ও গণিত শেখানো হতো সংস্কৃতে, কিন্তু তিনি সংস্কৃতের বদলে ব্যাকরণ বাংলার মাধ্যমে এবং গণিত ইংরেজির মাধ্যমে পড়ানোর নিয়ম চালু করেন। ইংরেজি ভাষা শেখাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন এবং ইংরেজি বিভাগকে উন্নত করেন। বাংলা শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দেন। তবে তারচেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করেন দর্শন পাঠ্যক্রমে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবল পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয়, বরং তাঁর অন্যান্য রচনা দিয়েও বাংলা গদ্যের সংস্কার এবং তার মান উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ এবং রামমোহন রায় যে বাংলা গদ্যরীতি নির্মাণ করেছিলেন, তা ছিল আড়ষ্ট, কৃত্রিম এবং কোনোমতে ভাব প্রকাশের উপযোগী। তাঁর আগেকার গদ্যে তথ্য প্রকাশের মতো শব্দাবলী ছিল কিন্তু তাতে এমন সৌন্দর্য, সাবলীলতা এবং গতির স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, যাকে সাহিত্যিক গদ্য বলা যায় বা যা দিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায়।

১৮৪৭ সালে ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর তা পাল্টে দিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের শব্দ-সাযুজ্য আবিষ্কার, বাক্য-কাঠামো সংস্কার, কর্তা ও ক্রিয়াপদ এবং ক্রিয়া ও কর্মের মধ্যে যথাযথ অন্বয় স্থাপন করে বাংলা গদ্যকে মাধুর্য দান করেন। তাছাড়া, শ্বাস-যতি ও অর্থ-যতির সমন্বয় ঘটান এবং পাঠক যাতে তা সহজেই দেখতে পান, তার জন্যে ইংরেজি রীতির যতিচিহ্ন, বিশেষ করে কমা, ব্যবহার করেন। তাঁর আগে একমাত্র অক্ষয়কুমার দত্তই ইংরেজি যতিচিহ্ন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ সালে রচনা করে ‘শকুন্তলা’ ও ১৮৬০ সালে রচনা করেন ‘সীতার বনবাস’; তাঁর এই দুই গ্রন্থে সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়।  এরই একটা নমুনা নীচে দেয়া হল- “শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)”।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘জ্ঞান ও মনীষার জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি তিনি তাঁর শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সাধারণ দেশবাসী তাঁকে আরেকটি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘দয়ার সাগর’ নামেই পরিচিত।’ এই উপাধি যে নিছকই শুধু উপাধি নয়, সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুনীতিকুমার জানিয়েছিলেন, ‘এই একটি উপাধির মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রের মস্ত বড় একটি দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে। একদিকে তিনি সুপণ্ডিত ও শিক্ষাব্রতী, তাঁর যুক্তিবাদী মননের ঔজ্জ্বল্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রত্যেকটি আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর হৃদয় দুস্থ মানবতার জন্য করুণায় বিগলিত।’ সেইসঙ্গে বিদ্যাসাগরের অবদানের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তাঁর দেশবাসীর জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সমাজের উন্নতির জন্য বিশেষত এদেশের নারীদের জন্য তিনি যা করেছিলেন, তার তুলনা নেই।’

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক সুনামগঞ্জ

সংবাদটি শেয়ার করুন