উত্তর বঙ্গের অন্যান্য জেলার চেয়ে ঠাকুরগাঁও জেলায় এবার তুলনামূলক আমন মৌসুমে বৃষ্টি-পাতের পরিমাণ কম হওয়ায় শ্যালো মেশিন দিয়ে ধান রোপন ও সেচ দিতে কৃষকদের চাষাবাদের খরচ বেড়েই চলেছে। এমন অবস্থায় আবার রাসায়নিক সারের কৃত্রিম সংকটে বাজারে বেশি দাম দিয়েও সার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ কৃষকদের। এতে কৃষি আবাদ নিয়ে চরম হতাশ ও অনিশ্চয়তা ভুগছেন চাষীরা।
সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে এমওপি, টিএসপি, ডিএপি সার ক্রয় করে আমন মৌসুমে ধান উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে কৃষকের। আমন রোপনের প্রথম ধাপে বেশি দাম দিয়েও অল্পস্বল্প সার পেলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে সার কৃষকরা সার পাননি বলে জানা যায়। এছাড়াও অতিরিক্ত টাকা দিয়েও এমওপি ও টিএসপি সার পাচ্ছেন না বলে এমননি অভিযোগ করেন স্থানীয় কৃষকরা।
সদর উপজেলার রামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুস সোবহান নামে এক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, ‘ডিলারদের কাছে সার কিনতে গেলে বলে সার নাই। আমরা সার ছাড়া এভাবে কিভাবে কৃষি করবো। মোহাম্মদ ইউনুস আলী নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা পটাশ (এমওপি) সার খুচরা বাজারে কিনতে গেলে ১ হাজার ৮০০ ও ইউরিয়া ১ হাজার ৪০০ টাকা নিচ্ছে। তাও আবার প্রথম ধাপে সার পেয়েছিলাম কিন্তু এখন বেশি দামেও সার পাচ্ছি না। বাজারে সার নেই।
ডিলাররা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত দামেই তারা সার বিক্রয় করছেন ও স্থানীয় কিছু কিছু খুচরা সার ক্রিতারা ডিলাদের কাছে সার না পেয়ে সার বিক্রয় বন্ধ রেখেছেন। ফলে কৃষকদের সার দিতে পারছেন না বলে জানান তারা।
সারের দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে পীরগঞ্জ উপজেলার বিসিআইসি’র সার ডিলারের প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সরকারের নির্ধারিত দামেই সার বিক্রয় করছি।’
সদর উপজেলার শিবগঞ্জ বাজারের খুচরা সার বিক্রেতা আলম বলেন, ‘আমি প্রায় গত দুই মাস থেকে পাচ্ছি না তাই দোকানে কৃষকরা সারের জন্য ভীর করলেও এক কেজি সারও দিতে পারছি না।’ আমন ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার দিতে না পেরে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কায় হতাশ কৃষকরা।
শিবগঞ্জ ডাঙ্গীপাড়া এলাকার মহসীন আলী নামে এক কৃষক দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছেন আমন ধান। তিনি বলেন, ‘সারের তাহেনে হেডা দোকান হইডা দোকন বেড়াছু কোনডা দোকানত সার পাউনা। এলা রোয়ালা কি করিম মুই? সারের তাহেনে রোয়ালা মোর নষ্ট হয়ে যাছে। সার নাই কেনহে? সার পাওয়া যায় না কেনহে? ব্যাপার কি?
এদিকে বিএডিসি’র ডিলাররা বলছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এমওপি সারের কোন বরাদ্দ না পাওয়ায় কৃষককে সার দিতে পারেননি।
অন্যদিকে অভিযোগ করে ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া হাটের বিএডিসি’র সার ডিলার ওহিদুল ইসলাম শাহ বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে টিএসপি ও ডিএপি সারের বরাদ্দ দিলেও আমরা এমওপি (পটাশ) সারের কোন বরাদ্দ পাইনি। তাই কৃষককেও পটাশ সার দিতে পারিনি।’
বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) শিবগঞ্জ ঠাকুরগাঁও বাফারগুদাম কার্যালয়ের তথ্য মতে, জেলায় বিসিআইসি’র মোট ৬৩ জন সারের ডিলার আছে। বর্তমানে এই গুদামে ইউরিয়া সারের মজুদ আছে সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বরাদ্দকৃত ইউরিয়া সার ৩ হাজার ৭২৪ মেট্রিক টনের মধ্যে ৩ হাজার ১০০ মেট্রিক টন সার বিতরণ করা হয়েছে।
এছাড়াও ঠাকুরগাঁওয়ের শিবগঞ্জ বিএডিসি’র উপ-সহকারী পরিচালক (সার) কার্যালয়ের সূত্র মতে, জেলায় বিএডিসি’র সার ডিলার মোট ১৪৯ জন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ৯৬৭ মেট্রিক টন টিএসপি ও ১ হাজার ৪৬ টন ডিএপি বরাদ্দকৃত সারের মধ্যে টিএসপি মজুদ আছে ৩৪১ দশমিক ৪৫ ও ডিএপি ৫৯১ দশমিক ০৫ মেট্রিক টন। সেপ্টেম্বর মাসে এমওপি সারের বরাদ্দ থাকলেও ১৯ তারিখ পর্যন্ত এমওপি সার গুদামে ছিল না। কিন্তু ২০ই সেপ্টেম্বরে এই গুদামে এমওপি সার মজুদ হয় ১৬৯ দশমিক ২৫ মেট্রিক টন।
ঠাকুরগাঁওয়ের শিবগঞ্জ বিএডিসি’র উপ-সহকারী পরিচালক (সার) জিল্লুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের বেশ কিছু দিন এমওপি সার ছিলনা বর্তমানে সার এসেছে। কৃষিমন্ত্রণালয় থেকে ডিলারদের বরাদ্দ দিলে তাদের এমওপি সার দিতে পারবেন।,
জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় এবার আমন ধান আবাদের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লখ ৩৭ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমি কিন্তু তার থেকেও ১০ হেক্টর বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আব্দুল আজিজ জানান, পরিবহনের জন্য এমওপি সার সময় মতো আসতে না পারায় সংকট দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন এমওপি সহ সকল প্রকার সার পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ আছে বলে জানান তিনি।
এদিকে সময় মতো সার না পাওয়া আমন ধানের ফলনসহ আগাম সবজি নিয়ে হতাশ ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন বলে জানান সদর উপজেলার কৃষক ইউসুফ আলী ও আল আমীন। তারা বলেন, ‘সারের অভাবে ধানের গাছের চেহেরা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কোথাও সার পাচ্ছি না। এভাবে সার না পেলে আমরা চাষাবাদ কেমনে করবো। আর কিছুদিন গেলেই আবার আলু লাগইতে হবে। আলুতে তো আরও বেশি সার লাগবে বিষেশ করে পটাশ, ইউরিয়া ও টিএসপি সার। কিন্তু পটাশ ও টিএসপি সার তো এখনি পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে সার না পেলে চাষাবাদ বন্ধ করে দিতে হবে আমাদের। জ্বলানি তেল সহ সারের দাম অতিরুক্ত বেড়েছে। এতো বেশি টাকা খরচ করে আমরা কৃষি কিভাবে করবো, আমরা কৃষকরা কাকে কি বলবো। আমাদের কথা কে শুনবে! আপনারা একটু আমাদের কৃষকদের দেখেন। আপনাদের মাধ্যমে আমরা সরকারকে বিনীত অনুরোধ করছি যে আমাদের কৃষকদের কম দামে ও সময় মতো সার যে সরকার দেয়। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনসহ কৃষি কর্মকর্তারা আমরা সার্বক্ষণিক সারের বাজার মনিটরিং করছি। তাই সার বেশি দামের বিক্রয়ের কোন সুযোগ নেই বলে দাবি করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ড. আব্দুল আজিজ আরও জানান, জেলায় সবজি ও আলু চাষের জন্যেও পর্যাপ্ত পরিমাণে সার মজুদ আছে। তাই কৃষকদের অধৈর্য না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।