বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) গত সাত বছরে একাধিক বিদেশি সংস্থা ১৫টি প্রস্তাব দেয়। তবে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে পারছে না চসিক। একই সময়ে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নেয়া উদ্যোগের বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, সিটি করপোরেশন এলাকায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাপ্ত প্রস্তাবসমূহ মন্ত্রণালয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (নগর উন্নয়ন) নেতৃত্বে একটি কমিটি আছে। কমিটি প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। গেল ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির সর্বশেষ সভায় বিদ্যুৎ বিভাগকে চসিকের প্রস্তাবনার বিষয়ে দ্রুত পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়।
চসিক সূত্রমতে, এ ব্যাপারে নেয়া ২০১৫ সালের উদ্যোগ থমকে আছে। ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন কোম্পানি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। পরে ২০১৫ সালে চট্টগ্রামসহ দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে নগরে ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর চসিকের সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো)।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী তৃতীয় পক্ষ বাছাই করবে পিডিবি। এরপর তাদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে প্রকল্পের পূর্ত কাজ শুরু হবে। বিওও (বিল্ড, ওন অ্যান্ড অপারেট) পদ্ধতিতে কেন্দ্রটি নির্মিত হবে। পরে বিদ্যুৎ বিভাগ দুই দফা দরপত্র আহ্বান করলেও প্ল্যান্ট নির্মাণে কোনো প্রতিষ্ঠান সাড়া দেয়নি। ফলে উদ্যোগটি আটকে যায়।
তখন বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করে, চাহিদা অনুযায়ী ভূমির ব্যবস্থা করতে পারেনি চসিক। এর আগে চসিক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ৬ দশমিক ০২ একর ভূমি প্রদানে সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় বলে ২০২১ সালের ১১ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানায় বাবিউবো। ২০১৫ সালের উদ্যোগটি থমকে গেলেও চসিকে প্রস্তাব আসা বন্ধ হয়নি। এর মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া ১০টি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চসিক, যা ওই সময় মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে প্রেরণ করা হয়।
প্রস্তাব দেয়া কোম্পানিগুলো হচ্ছে- ন্যানোটেক সলিউশন অ্যান্ড কনসালটেন্সি লিমিটেড, ইম্প্যাক্ট এনার্জি, ফাইভ কো-ফার্ম-এমই-এইচআইটিজেড-স্টার্টেম কনসোর্টিয়াম, অকল্যান্ড গ্রিন এনার্জি লিমিটেড, সিটি ডেভেলপমেন্ট এনভায়রনমেন্ট কোম্পানি, সোলার্স পাওয়ার লিমিটেড, সিঙ এলিমেন্ট এনার্জি, রাফা এনভায়রনমেন্টাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ও এসডিআইসি।
বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পর ২০২১ সালের ৩ মে চায়নিজ ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা মেয়রের সঙ্গে দেখা করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। তারা দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার প্রস্তাব দেন। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য দৈনিক ১২০০-১৩০০ টন বর্জ্য এবং প্রতি কেন্দ্রের জন্য ১২-১৩ একর করে জমি প্রয়োজন বলে চসিককে জানায়।
একই সময়ে সৌদি-জার্মান টেকনোলজি লিমিটেড নামে বিদেশি প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রস্তাব দেয়। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪০ একর ভূমির কথা জানায়। প্রতিষ্ঠানটি বর্জ্য সংগ্রহ, সংগ্রহের জন্য যাবতীয় যানবাহন ও লোকবল, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়াসহ সব ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে আগ্রহী।
এর আগে চসিকের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দায়িত্ব পালনকালে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর সোলার্স পাওয়ার লিমিটেডের অঙ্গ সংগঠন এনডিওরিং এনার্জিও প্রস্তাব দেয়। তারা জনায়, সলিড রিকভারড ফুয়েল (এসআরএফ) পদ্ধতিতে ৩০ একর জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। এজন্য দরকার হবে আড়াই হাজার টন বর্জ্য। এসআরএফ পদ্ধতিতে কয়লা থেকে ফুয়েলের (তেল) মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ শতাংশ কার্বন, ৮৫ শতাংশ নাইট্রোজেন, ৯০ শতাংশ সালফার, ৫০ শতাংশ ক্লোরিন নিঃসরণ করে কয়লার চেয়ে পানির মাধ্যমে ৪০ শতাংশ সমন্বয় সাধন করা যাবে প্রকল্পে, যা পরিবেশের জন্য উপযোগী।
এদিকে গত বছরের ১৮ নভেম্বর নগরের একটি হোটেলে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ সময় তিনি ২০২২ সালে নগরে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন। যদিও বাস্তবে তার অগ্রগতি নেই।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১৩ সালে ইতালির কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএলের সঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি চুক্তি হয়েছিল। কথা ছিল, কোম্পানিটি রাজধানীর বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি করে ১০০ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, আমরা ১৫টি প্রস্তাব পেয়েছি। সবগুলোই মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখনো কোনো কোম্পানি চূড়ান্ত করেনি। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে কোয়ারি চায়, আমরা সেগুলো পাঠিয়েছি। জায়গা সংকটের কারণে প্রকল্প আটকে আছে কিনা জানতে চাইলে মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, মন্ত্রণালয়কে আমরা জানিয়েছি প্রয়োজনীয় ভূমির ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
চসিকের নগরীর হালিশহরের আনন্দবাজারে ১৫ একর এবং বায়েজিদের আরেফিন নগরে ১৯ একর জমি রয়েছে। এ জমিতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব।