ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একজন নিভৃতচারী

একজন নিভৃতচারী

ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও অতি সাধারণ জীবন যাপন। দেশের একটি স্বনামধন্য বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও, সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আড়ালে যিনি রয়েছেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ থাকে যাঁরা নিজেদের নিয়ে কখনো এতটা ভাবেন না। উজ্জ্বল আলোয় নিজেদের আলোকিত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আড়াল রাখেন নিজেদের। এমন মানুষ খুব বেশি পাওয়া যায় না। শেখ রেহানার চলাফেরা, আচার আচরণে আমরা দেখতে পাই এক নির্মোহ জীবনাচরণের প্রতিচ্ছবি।

শেখ রেহানা একজন সাধারণের মতোই জীবনযাপন করেন। তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হলেও জনকল্যাণকর কাজে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছেন। সাহস ও সক্ষমতার পরিচয় দেখিয়ে অনেক স্থানে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার পারিবারিক শিক্ষা, বিশেষ করে মায়ের দেওয়া শিক্ষা, ধৈর্য, সাহস, বিচক্ষণতা, অধ্যবসায়, ত্যাগ ও নির্লোভতা তার চলার পথকে অধিকতর সুন্দর ও সুগম করেছে।শেখ রেহানা দলীয় পরিমণ্ডলে ছোট আপা হিসাবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। কৈশোর পেরিয়েই হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাইদের। হারিয়েছেন স্বদেশের অধিকার। দেশে দেশে ঘুরেছেন গৃহহীন, আশ্রয়হীন পরিবেশে। নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল না কোথাও।

সততার চুড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলেই শেখ রেহানা তার নিজের নামে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ২০০ কোটি টাকা মূল্যমানের ঢাকার ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের জন্য দান করে দিয়েছেন। তিনি মানুষকে স্নেহ, আদর, মমতা ও ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে পারেন। দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে। মা ফজিলাতুননেছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন তেমনভাবে পর্দার অন্তরালে থেকে বড় বোন শেখ হাসিনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

শেখ রেহানা বেগম মুজিবের পরিপূরক হয়ে উঠেছেন তার কর্মে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিপর্যস্ত সময়ে মমতায় আগলে রাখেন ও সঠিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন দক্ষতার সাথে। শেখ রেহানার জীবনালেখ্য নিয়ে হয়তো বেশি কিছু জানা যায়নি, তবে তার জীবনের গভীরতা অনুধাবন করা যায় ব্যাপকভাবে। আওয়ামী লীগের তিনি কোনো নেতা না হলেও দলের ক্রান্তিকালে তিনি যেন আশা-ভরসার স্থান। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। সে সময় শেখ হাসিনার মুক্তির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে এবং আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে শেখ রেহানা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৯ সালের ১০ মে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের এক সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল; কিন্তু সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগদান করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তখন নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনাও টেলিফোনে ছোট বোনকে সম্মেলনে যেতে নিদের্শনা প্রদান করলে শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে শেখ হাসিনার প্রেরিত বাণী পাঠ করেন। এটিই ছিল শেখ রেহানার কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে প্রথম বক্তব্য। আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনিই প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে পঁচাত্তরের ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছিলেন।

শেখ রেহানা ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা যখন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে, তখন তিনি বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানির কার্লসরুইয়ে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। অতঃপর সেখান থেকে ভারতে চলে যান দুই বোন। শেখ রেহানা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় যুক্তরাজ্যে বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই মোমিনুল হক খোকা চাচা ও ফুপা জেনারেল মোস্তাফিজ থাকায় সেখানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বিমানের ভাড়া না থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টি জানতে পেরে তিনি টিকিটের টাকা শেখ রেহানার কাছে পাঠালে তিনি তাদের প্রিয় খোকা চাচার কাছে লন্ডনে চলে যান। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু তিনি। ড. শফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সে সুবাদে তিনি পিএইচডি করার জন্য ব্রিটেনের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত ছিলেন। ১৯৭৭ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে লন্ডনের কিলবার্নে খোকা চাচার বাড়িতে ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে শেখ রেহানার বিবাহ সম্পন্ন হয়। কণ্টকপূর্ণ ছিল শেখ রেহানার জীবন। জীবনের বিস্তীর্ণ পথ তাকে লড়াই করে কাটাতে হয়েছে।

বিবাহের পর শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানাকে নানামুখী সংকট মোকাবিলা করে অগ্রসর হতে হয়েছে। শেখ রেহানা পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি জয় করে তিনি নিজের সন্তানদের সুশিক্ষিত ও রাজনীতিসচেতন করে গড়ে তুলেছেন। তার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শফিক। শেখ রেহানা দম্পতির এক ছেলে, দুই মেয়ে রয়েছে। তিনি একজন রত্নগর্ভা মা বটে। জ্যেষ্ঠ কন্যা রেজওয়ানা সিদ্দিক টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এমপি। কনিষ্ঠ কন্যা আজমিনা সিদ্দিক অবন্তি লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক। পুত্রসন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত।

নেপথ্যে থেকেই তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কখনো পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে চাননি। ক্ষমতার মোহ তাকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি কখনো । ইচ্ছে করলেই হতে পারেন এমপি, মন্ত্রী। ইচ্ছে করলেই অর্জন করতে পারেন অর্থ বিত্ত। কিন্তু নির্মোহ শেখ রেহানা অর্থ বিত্তের মোহ থেকে দূরে রেখেছেন নিজেকে সব সময় ।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

সংবাদটি শেয়ার করুন