ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাবিতে স্বাস্থ্যবিমায় ঢিলেমি

ঢাবিতে স্বাস্থ্যবিমায় ঢিলেমি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সব শিক্ষার্থীকে গত বছরের অক্টোবরে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় নিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সেবার কথা চিন্তা করে এই যুগান্তকারী প্রকল্পটি হাতে নেয় ঢাবি। কিন্তু বছর না যেতেই উঠে এসেছে নানা অভিযোগ। সময়মতো সুবিধা নিতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। বিমা দাবি (ক্লেইম) করতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে নানা জটিলতায়। দাবির অর্থ তুলতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এছাড়াও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অফিসে দায়িত্বরত কর্মচারী ও স্বাস্থ্য বীমা খাতে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে দায়িত্বরত কর্মচারীদের ব্যবহারে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ফলে একদিকে স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা নিতে বিমুখ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে লাভবান হচ্ছে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দায়িত্বরত কর্মচারীদের গাফিলতির কারণে তাদের দাবি করা অর্থ পেতে ৩ থেকে ৪ মাস লেগে যাচ্ছে। যে কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই বিমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হয়রানির কারণে নিজের টাকায় চিকিৎসা নিয়ে কষ্ট হলেও স্বাস্থ্যবিমার সেবা নিতে আর আসছেন না তারা।

নাম প্রাকশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় বর্ষের ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান,  প্রচণ্ড জ্বর ও মাথা ব্যথা হওয়ার কারণে বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার দুদিন পর সুস্থ হয়ে উঠি। এতে আমার চিকিৎসা ও পরীক্ষা ফি বাবদ মোট ৮৮০ টাকা খরচ হয়। পরে বন্ধুরা আমাকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় দাবি করতে বলে। কিন্তু আমার পাশের রুমমেট চার মাস আগে অসুস্থ হয়ে মেডিকেলে যে চিকিৎসা নিয়েছে সেই খরচের টাকা ফিরে পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়। ডিপার্টমেন্টে সব ডকুমেন্ট জমা দেয়ার পর চার মাস ধরে চেষ্টা করেও বিমার টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়। তার সেই হয়রানির শিকার হওয়া দেখে আমি আর স্বাস্থ্যবিমায় দাবি করতে যাইনি।

বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্য বিমার টাকা না দিলে অনলাইনে ফরম ফিলাপ ও ভর্তি প্রক্রিয়াই শুরু করা যায় না। অথচ এই অথর্ব বিমা প্রতিষ্ঠান দাবি করা টাকা ফেরত দিতে মাসের পর মাস সময় নেয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই অথর্ব, কচ্ছপ গতিসম্পন্ন, অপেশাদার, কাণ্ডজ্ঞানহীন, রাঘব বোয়াল, বিমা প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে সেবামুখী আচারণ আচরণ শেখানোর জোর দাবি জানাচ্ছি।

আল আমিন শাহরিয়ার নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, গত জুলাই মাসের ৩ তারিখে স্বাস্থ্য বিমার টাকা দাবি করি। এরও একমাস পরে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খোঁজ নিলে বলে, তাদের কাছে এখনো কোনো টাকা এসে পৌঁছায়নি। স্বাস্থ্য বিমার টাকা তাদের হাতে পৌঁছালে আমাকে কল দেওয়া হবে। দু’মাসেরও বেশি সময় পেরুলেও টাকা দেওয়ার কোনো নাম নেই। তাছাড়া টাকা পেলেও বিভিন্ন শর্তের নাম করে শেষপর্যন্ত তারা ছাত্রছাত্রীদের নামমাত্র টাকাই দেয়।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান মুসাফির বলেন, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩ অথবা ৪ তারিখে আবেদন করি স্বাস্থবিমার টাকার জন্য। সকল শর্ত ও নিয়ম-নীতি পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। কিন্তু এখনও টাকা ডিপার্টমেন্টে আসে নি। আর আসবে কিনা তার কোনো হদিস ডিপার্টমেন্টের কাছে নেই। যদিও দুই মাস পার হয়েছে। দাবি করা বিমার টাকা পাব কি না এ বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা বা কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

আবার এদিকে দাবি করে টাকা পাওয়ার পর সন্তুষ্ট নন ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ঈদমুল হাসান সাকিব। ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন বলেন, বিমা দাবি করার ৪ মাস পর টাকা পেয়েছি। তবে আমি দাবি করেছিলাম ৮ হাজার টাকা। অথচ শেষ অবধি তারা আমাকে দিয়েছে মাত্র তিন হাজার টাকা। ওই শিক্ষার্থী আরও জানান, চিকিৎসা করার দুই মাস পরে নাকি টাকা দেওয়া হয় না। দুই মাসের মধ্যেই বিল জমা দিতে হয়। অথচ এসব নিয়ম কোথাও উল্লেখ করা ছিল না। এসব বিষয় আগেই শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিষ্কার করা দরকার ছিল।

সূত্রমতে, গেল অর্থবছর ২০২১-২২ থেকে ঢাবিতে স্বাস্থ্য বিমা চালু হয়। বিমাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পায় যমুনা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বিমা শর্তে বলা হয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বিমাসুবিধা পাবেন। এর মধ্যে হাসপাতালে থাকাকালীন কেবিন বা ওয়ার্ডের ভাড়া, হাসপাতাল সেবা, অস্ত্রোপচারজনিত ব্যয়, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি, ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল বাবদ দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা চিকিৎসা ব্যয় পাওয়া যাবে।

বহির্বিভাগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বছরে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে বহির্বিভাগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় অর্ন্তভুক্ত থাকবে ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ফি বাবদ প্রতি ব্যবস্থাপত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পাওয়া যাবে। কোনো শিক্ষার্থীর বয়সসীমা ২৮ বছর অতিক্রম করলে অথবা ছাত্রত্ব হারালে বিমাসুবিধা পাবেন না।

এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ তাদের বিমার দাবির বিষয় তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ইচ্ছেমতো ফি দিয়ে দেয়। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে দায়িত্বরত সেলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

দায়িত্বরত স্বাস্থ্যবিমা সেল থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রথমে বিভাগীয় কার্যালয়ে শর্তানুযায়ী সকল কাগজপত্র জমা দেয়। অফিস কাগজপত্র পরীক্ষা করার পর আমাদের এখানে পাঠায়। পরে আমরা অর্থের জন্য সুপারিশ করি। টাকা ফেরত পেতে এত বেশি সময় লাগে কেন? জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর না দিয়ে দায়িত্বরতরা বলেন, এটা শেষ করতে একটু সময় লাগে। তবে যাদেরটা খুবই জরুরি সেটা আমরা তাড়াতাড়ি করে দেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যবিমার রেজিস্টার খাতার তথ্য মতে, বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে জন প্রতি ২৭০ টাকা করে রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দিয়েছেন ৩৫ হাজার ৫১৮ জন শিক্ষার্থী। যা মোট টাকার অঙ্কে ৯৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬০ টাকা। এদিকে সারা অর্থবছরে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করেছেন মোট ১ হাজার ১০২ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর শতকরা ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিমার টাকার জন্য দাবি করেন। হিসাবে দেখা যায়, বিমাকারী প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্ধেকের বেশি।

রেজিস্টার খাতার তথ্যমতে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার পর খরচ হওয়া অর্থের দাবিতে আবেদন করেছেন ৯৮৮ জন শিক্ষার্থী। প্রথমবর্ষ থেকে ৩৩ জন, দ্বিতীয়বর্ষ থেকে ১৮৬ জন, তৃতীয়বর্ষ থেকে ২৫২ জন, চতুর্থবর্ষ থেকে ২৪০ জন এবং মাস্টার্স থেকে ২৭৭ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে টাকা উত্তোলন করতে পেরেছেন ৬৫৪ জন এবং সব নিয়ম মেনে এখনও দাবি করা টাকা তুলতে পারেননি ৩৩৪ জন।

অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর ব্যয় হওয়া অর্থের দাবিতে আবেদন করেছেন ১১৪ জন শিক্ষার্থী। প্রথমবর্ষ থেকে ১০ জন, দ্বিতীয়বর্ষ থেকে ২১ জন, তৃতীয়বর্ষ থেকে ৩০ জন, চতুর্থবর্ষ থেকে ২৭ জন, এবং মাস্টার্স থেকে ২৬ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে টাকা উত্তোলন করতে পেরেছেন ৬৩ জন এবং সকল নিয়ম মেনেও দাবির টাকা এখনও তুলতে পারেন নি ৫১ জন।

এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয় স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদের সঙ্গে। যিনি সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে ঢাবিতে স্বাস্থ্যবিমা চালুর ক্ষেত্রে অগ্রনায়কের ভুমিকা পালন করেন। ওই শিক্ষক সমস্ত অভিযোগের কথা শুনে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বিমা কোম্পানি ও বিশ্ববিদ্যালয়কে চাপ দিবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তিনি বলেন, বিমা কোম্পানি টাকা দিতে দেরি করার কারণেই শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসতে হবে।

দাবি করে টাকা উত্তোলন বিষয়ে প্রফেসর ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, যখন আমরা এই স্বাস্থ্যবিমাটি চালু করি তখন আমি চেয়েছিলাম ডিপার্টমেন্ট, বিমা কোম্পানি, একজন শিক্ষক এবং একজন কর্মকর্তাকে এই সম্পূর্ণ বিমা পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য আলোচনায় বসতে। যাতে একজন শিক্ষার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য পরবর্তীতে সেটা করেছিলো। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এক্ষেত্রে ডিপার্টমেন্টগুলোর গাফিলতি সবচেয়ে বেশি।

যমুনা লাইফ ইন্সুরেন্স লিমিটেডের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে বিমা দাবির অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪৭ লাখ টাকা। বিমার অর্থ পেতে বিলম্বের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর ব্যবস্থাপনাকে দায়ি করেন বিমা কোম্পানির কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে যমুনা লাইফ ইন্সুরেন্স লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হারুনুর রশিদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রথমে ডিপার্টমেন্টে আবেদন করে। তারপর ওই কাগজ ডিপার্টমেন্ট ও রেজিস্টার বিল্ডিং হয়ে আমাদের কাছে আসে। আমাদের এখানে প্রসেস হতে ২০ অথবা ৩০ দিন লাগে। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ডিপার্টমেন্টের অফিসে ২ থেকে আড়াই মাস পড়ে থাকে। যে কারণে ৪ থেকে ৫ মাস লেগে যায়।

শিক্ষার্থীরা যে টাকা দাবি করে, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তা কম টাকা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে হারুনুর রশিদ বলেন, অনেক সময় শিক্ষার্থীরা আমাদের চুক্তির বাইরের বিষয়গুলো দাবি করে। যে বিষয়গুলোর সেবা আমাদের প্রতিষ্ঠান দেয় না। এক্ষেত্রে একটু কম বেশি হয়। তবে এসব নিয়ে আমরা কাজ করছি। শিক্ষার্থীদের সেবা নিয়ে নতুন করে অনেক কিছু সিদ্ধান্ত বদলে আলোচনা করছি। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলমান।

সংবাদটি শেয়ার করুন