ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উপকূল রক্ষার প্রকল্প হিমঘরে

উপকূল রক্ষার প্রকল্প হিমঘরে

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত দীর্ঘদিন ধরেই ভাঙনের কবলে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাবে সম্প্রতি ভাঙন তীব্র আকার ধারন করেছে। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে বাঁচাতে বছর দুয়েক আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে প্রতিরক্ষা বাঁধ কাম রোড় প্রকল্প হতে নেয়া হয়। তবে এখন অবধি প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) থেকে অনুমোদন দেয়া হয়নি।

সম্প্রতি সৈকতে ভাঙনের মাত্রা তীব্ররকম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়েই চলতে বিপর্যয়। তারই অংশ হিসেবে পর্যটননগরী কক্সবাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে। উপকূল রক্ষার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নই এই বিপর্যয় থেকে মুক্তির উপায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তিন হাজার ৪১০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বহুমুখী ( মাল্টি ফাংশানাল) বাঁধ কাম রোড প্রতিরক্ষা বাঁধ প্রকল্পটি বর্তমানে একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে সেটা কবে নাগাদ অনুমোদন পাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করতে পারছেন না কেউ। প্রকল্প ফাইলবন্দি হয়ে উপকূল রক্ষায় তেমন উদ্যোগ নেই। বরং সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ অংশের ভাঙনে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রকল্প অনুমোদন দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।

পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ভাঙনের কবলে পড়েছে আরও অন্তত তিন/চার বছর আগে থেকে। বর্তমানে ভাঙন তীব্রতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী ডায়াবেটিক, শৈবাল, কবিতা চত্ত্বর, কলাতলী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর ও সুগন্ধা পয়েন্ট সমুদ্রের ঢেউয়ের তাণ্ডবে প্রতিদিনই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিদ্যা ইনস্টিটিউটের (ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস) সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ঘনঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে বড় বড় ঢেউ উপকূলে শক্তিশালী হয়ে আছড়ে পড়ছে। উচ্চশক্তির এই ঢেউ উপকূলের বালু সরিয়ে দেওয়ায় সৈকতে ভাঙন দেখা দিচ্ছে।

ড. মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী আরও বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় সমুদ্র স্রোতের প্রকৃতি ও ঢেউয়ের তীব্রতা এবার অন্যরকম মনে হচ্ছে। এছাড়া মানবঘটিত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলেও তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

ভূ-তত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিক মো. জাকারিয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে সমুদ্র একদিকে ভেঙে অন্যদিকে ভরাট হয়। এটি সমুদ্রের নিয়ম। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরে সমুদ্র উপকূল বেশি ভাঙছে এবং ভেঙে যাওয়ার ধরণটি অন্যরকম।

জানতে চাইলে সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. শফিকুর রহমান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের গতিধারায় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা বারবার আঘাত করছে। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ও বাড়ছে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ী ও হোটেল মোটেল জোনের সভাপতি মুকিম খান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, গেল ৩০ বছর ধরে কক্সবাজারকে দেখছি। কখনো ভাঙন, কখনো ভরাট হতে। সর্বশেষ গেল চার বছরের অব্যাহত ভাঙন ক্রমাগত বাড়তে থাকায় কক্সবাজারের মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। যা সৈকত কেন্দ্রীক ব্যবসায়ীদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ক্ষয়-ক্ষতি চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানান এই পর্যটনখাতের ব্যবসায়ী।

এদিকে, উপকূলে ভাঙনের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে গত ১২ আগস্ট পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার এসেছিলেন। পরিদর্শনকালে সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, সমুদ্রসৈকতের ভাঙন ঠেকাতে একনেকে তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প জমা দিয়েছি। নাজিরারটেক থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ হবে। তখন হয়তো সাগরের ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।

পাউবোর দেয়া তথ্য মতে, সৈকতের ভাঙন রক্ষায় মাল্টি ফাংশানাল বাঁধ কাম রোড প্রতিরক্ষা বাঁধ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল ২০২০ সালে। যেটি আটকে আছে গত দুই বছর ধরে। দুই হাজার পাঁচশ কোটি টাকার ব্যয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সংশোধিত হয়ে তিন হাজার ৪১০ কোটি টাকায় উন্নত করা হলেও এখনো আলোর মুখ দেখে নি।

পাউবোর তথ্যমতে, প্রকল্পটি ১২ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে। যা শহরের নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে কলাতলী মূল পয়েন্ট পর্যন্ত। যেখানে ওয়াকওয়ে, সাইকেল বে, গাড়ি পাকিং, প্রদর্শনী মঞ্চ থাকবে। আর বাঁধের ভেতরে থাকবে কিডস জোন, তথ্য কেন্দ্র, লকার রুম, লাইফ গার্ড পোস্ট, ওয়াশরুম। পুরো প্রকল্পটি সাজানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। বালিয়াড়িতে থাকবে না কোনো প্রকার স্থাপনা। সকল প্রকার স্থাপনা চলে যাবে বাঁধের অভ্যন্তরে। ফলে উপকূল এলাকা সুরক্ষিত থাকবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্প অনুযায়ী, ১২ কিলোমিটার মাল্টিফাংশনাল বাঁধ কাম রোডটি থাকবে ৫ কিলোমিটার সাইকেল বে, ৪.৮০ কিলোমিটার ওয়ার্কি বে, ৮টি ফুটওভার ব্রিজ, ৭শ সিটিং ফ্যাসিলিটি, ১টি ল্যান্ডস্কেপ, ১টি প্রদর্শনী স্থান, ১০টি তথ্য কেন্দ্র, ১টি শিশু পার্ক, ১টি বাস পার্কিং স্থান, ১টি আলোকসজ্জা, ১টি ইটিপি সমৃদ্ধ পানি ব্যবস্থাপনা, ১টি একুইরিয়াম, বাইরের রেঁস্তোরা ১টি, ১৮টি লাইভ গার্ড স্টেশন, ১০টি ভাস্কর্য।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, ভাঙন রোধে পর্যটন এবং পরিবেশবান্ধব প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি এখনও পরিকল্পনা কমিশনে জমা রয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে একনেকে উপস্থাপন হবে। তবে বলা যাচ্ছে না এই কাজ কখন শুরু করা সম্ভব হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রমতে, ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল জোন বাদ দিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করা যেতে পারে। আর উপকূল এলাকায় যে সমস্ত স্থাপনা রয়েছে সব কটি গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই পরে অবারিত সমুদ্র সৈকত পূর্বের চেহারায় ফিরে আসতে পারে।

এদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বাংলাদেশের অহংকার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। অথচ উপকূল এলাকায় শত শত স্থাপনা, সমুদ্র সৈকতকে দ্বিখণ্ডিত করে জেটি নির্মাণ, সৈকতের আশেপাশে ছোট বড় খালও ছড়া বন্ধ করে দিয়ে অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরি ও একেবারে সমুদ্রের জোয়ার ঘেঁষে বহুতল ভবন, যা জোয়ার ভাটার গতি প্রকৃতিতে বাধা সৃষ্টির কারণে একের পর এক সৈকত বেলাভূমি তলিয়ে যাচ্ছে সাগর গর্বে।

ফজলুল কাদের চৌধুরী আরও বলেন, সাগর তীর রক্ষায় বাঁধে আপত্তি নেই। তবে তা হতে হবে পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে রক্ষা করে। না হয় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মিত বাঁধও সাগর জলে তলিয়ে যাবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন