- ওভারটেক করতে গিয়ে নসিমনের তিন যাত্রী নিহত
নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কুষ্টিয়া শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রুট পারমিটবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ যান নসিমন-করিমন, আলমসাধু ও শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ট্রলিসহ অন্যান্য যানবাহন। দেশীয় লোহা-লক্কড় ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবেই তৈরি হচ্ছে এসব যানবাহন। কুষ্টিয়ায় এ ধরনের অবৈধ যান তৈরির অন্তত ৫০ কারখানা গড়ে উঠেছে। শুধু এ কুষ্টিয়ায় নয়, এসব যানবাহন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের জেলাগুলোতেও।
অভিযোগ রয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করেই বহাল তবিয়তে চালানো হচ্ছে নসিমন-করিমনসহ ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন। এতে দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
গতকাল সোমবার ভোরে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়কের কুমারখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় তিন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন ৯ জন। নিহতরা হলেন- দৌলতপুর উপজেলার ৭নং হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের শশীধরপুর গ্রামের মৃত বারি দফাদারের ছেলে গাফফার (৩৮), একই এলাকার আজিল পরামাণিকের ছেলে সানোয়ার (৪০) ও জাহিদ।
তারা দৌলতপুর থেকে রাজবাড়ীতে পেঁয়াজ কেনার জন্য নসিমন যোগে যাচ্ছিলেন।
কুষ্টিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইদ্রিস আলী জানান, সবজিবোঝাই একটি শ্যালোইঞ্জিন চালিত নসিমনের চালক আরেকটি নসিমনকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয়। এ সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক তাদের ধাক্কা দিয়ে খাদে পড়ে যায়। এ ত্রিমুখী সংঘর্ষে নসিমনে থাকা তিন যাত্রী ঘটনাস্থলে নিহত হন। এ সময় আরও যাত্রীরা আহত হয়। তাদের উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মরদেহগুলো একই হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে বলে জানান পুলিশের ওসি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সর্বত্র বিশেষ করে কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, খোকসা, ভেড়ামারা, মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলায় ইট, বালু, পাথর, রড, সিমেন্ট ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরযান আইনে অবৈধ নসিমন, নসিমন-করিমন, আলমসাধু ও শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ট্রলিসহ বিভিন্ন যানবাহন। সড়কে অবাধে এসব যানবাহন চলাচল করায় জেলার সচেতন মানুষ শুধু বিরক্তিই নয়, তারা আতঙ্কিতও বটে। কারণ এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। অবৈধ এ যান চলাচলের বিরুদ্ধে পুলিশ কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুষ্টিয়ায় স্থানীয়ভাবেই তৈরি হচ্ছে এসব যানবাহন। জেলায় এ ধরনের অন্তত ৫০ কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব ওয়ার্কশপে দীর্ঘদিন যাবত তৈরি হচ্ছে নসিমন-করিমন, আলমসাধু ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলিসহ বিভিন্ন যানবাহন। মোটরযান আইনকে তোয়াক্কা না করে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে জীবনের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ এসব যান। মোটরযান আইনে স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব যানবাহনের কোন বৈধতা নেই। লোহার এ্যাঙ্গেল এবং অন্য সামগ্রী ব্যবহারে চেসিসসহ তৈরি করা এই যানবাহন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
এর ব্রেক সিস্টেম ও ইঞ্জিনের গতি তাৎক্ষণিক কমানোর যান্ত্রিক পদ্ধতিও ত্রুটিপূর্ণ। সেচ কাজে ব্যবহার্য ডিজেলচালিত শ্যালো ইঞ্জিন সংযুক্ত বেপরোয়া গতির এ যানবাহন অহরহ ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার জন্য মূলত এর নির্মাণজনিত ত্রুটি ও অদক্ষ চালকদেরই দায়ী করছেন সচেতন মানুষ।
এর চালকদের অনেকেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা তো দূরের কথা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। ফলে এসব আনাড়ি চালকেরা নিজেরা যেমন দুর্ঘটনায় পড়ছে তেমনি মহাসড়কের অন্য যানবাহনগুলোকেও দুর্ঘটনায় পড়তে বাধ্য করছে। তার ওপর দেড় থেকে আড়াই টন পর্যন্ত ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এসব যানবাহনে ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ও মালামাল বহন করা হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি জেলায় গড়ে ওঠা অন্তত ২শ’ ৫০ ইটভাঁটির ইট প্রস্তুতের মাটি ও কাঠ সরবরাহ এবং ইমারত নির্মাণে তৈরি ইট সরবরাহে অবৈধ এই যানবাহন ব্যবহার করা হচ্ছে।
হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মহাসড়কে এসব অবৈধ যানবাহন কিভাবে চলাচল করছে, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ রয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করেই বহাল তবিয়তে চালানো হচ্ছে এসব যানবাহন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়া বাজারে একটি ওয়ার্কশপে প্রতিমাসে দুই শতাধিক নসিমন-করিমন তৈরি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া এই বাজারেই রয়েছে আরও অন্তত ২০টি ওয়ার্কশপ। এসব ওয়ার্কশপে তৈরি অবৈধ যানবাহন আশপাশের জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতাসহ মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হলেও অবৈধ যানবাহনের উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। ফলে কুষ্টিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নিরাপদ সড়ক এবং দুর্ঘটনা এড়াতে সড়ক-মহাসড়কে সব ধরনের অবৈধ যান চলাচল বন্ধের দাবি জানান সচেতন মহলরা।