বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মানবতত্ত্ব নিয়ে সব সময় ভাবতেন। মানবজীবনের গুঢ় রহস্য নিয়ে তার ভাবনা ছিল প্রবল। মানবজীবন নিয়ে তিনি বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। মানবজীবনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে গিয়ে তিনি বলেন-
‘মানবতত্ত্বের কী মাহাত্ম্য
বোঝে কয়জনে
মানবতত্ত্ব প্রকাশিল
অতি সন্ধানে’।
শাহ আবদুল করিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আস্থাশীল। তিনি তাঁর এবং তাঁদের বাল্যের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করে বর্তমান কালের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন দৃষ্টে ব্যথিত হয়েছেন। সে বেদনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাই গানের বাণীতে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।… গ্রামের নও-যোয়ান হিন্দু-মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম/ আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
আমাদের সাধের মানবজীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আমরা এখানে ক্ষণিকের অতিথি মাত্র। এ পৃথিবীর রূপ রস ও সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে পৃথিবীকে দেখে, সৃষ্টিকে দেখে। চলতে চলতে অনিবার্য সমাপ্তির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের সকলকেই। শাহ আবদুল করিম তাঁর গানে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এভাবে-
‘আমি আছি আমার মাঝে
আমি করি আমার খবর
আমি থাকলে সোনার সংসার
আমি গেলে শূন্য বাসর’।
শাহ আবদুল করিম তাঁর সঙ্গীত জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রথম থেকেই আমার গানের প্রতি টান। হিন্দু মুসলমানের দেশ গানের একটা পরিবেশ ছিলো। দাদা সারিন্দা নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতো।
‘ভাবিয়া দেখো মনে
মাটির সারিন্দা বাজায় কেমনে’…
গানটা একেবারে ছোটবেলাতে শাহ আবদুল করিমের মনে গভীর দাগ কাটে। তারপর দিনে দিনে তিনি একসময় কেবল গানের সুর-বাণীতেই নিজেকে সমর্পিত করেন। এ কথাটি তিনি তাঁর গানেই প্রকাশ করেছেন সুর-বাণীর যুগল সম্মিলনে,
‘আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া’।
তবে, একথাও ঠিক যে, শাহ আবদুল করিমের গান বিনোদনধর্মী কোনো গান নয়। তাঁর গানে বিভিন্ন তত্ত্বকথা ও জীবন দর্শন যেন একাকার হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, দেহতত্ত্বের সঙ্গে দেহ শব্দটি আছে। আর এই দেহ তো শরীর। এর মধ্যে কী কী বস্তু আছে। দেহের মধ্যে চক্ষু আছে, কর্ণ আছে… এ সমস্ত আর কি। আমি এসব বুঝি বলে, মানুষে আমাকে পীর বলে মানে। আসলে, দেহ সম্পর্কে যারা ভালো জানেন তাদেরই পীর বলা হয়। এই ধারায় আমার মুর্শিদের নাম মুওলা বক্স। মানুষের জীবনে পীরদের ভজতে হয়। আর পীর ভজলেই তত্ত্ব কথা পাওয়া যায়।
দেহের মধ্যেই সকল সত্য নিহিত থাকে । দেহ আত্মা ইত্যাদির তত্ত্বই দেহতত্ত্ব। পঞ্চেন্দ্রিয়যুক্ত দেহই যে সকল শক্তির আধার এবং ইহাই যে আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র পথ- এসব বর্ণনাই দেহতত্ত্ব গানের উদ্দেশ্য। শাহ আবদুল করিমের দেহতত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য গান-
‘আগে দেহের খবর জানরে মন,
তত্ত্ব না জেনে কি হয় সাধন ।
দেহে সপ্তস্বর্গ সপ্ত পাতাল
চৌদ্দ ভুবন কর ভ্রমণ।
দেখনা খুঁঝে কোথায় বিরাজে
তার পরম গুরু আত্মারাম।”
শাহ আবদুল করিমের জন্মের মাত্র বছর দুই আগে দেহ রাখেন বাউল সাধক কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁই। সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অন্যান্য সাধকগণ হলেন হাসন রাজা, শীতালং শাহ, রাধারমণ, দূরবীণ শাহ প্রমুখ। তাঁদের সবার গান ও জীবন দর্শনে শাহ আবদুল করিম স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। লালন ফকিরের গান সম্পর্কে তিনি বলতেন-
আমি লালন ফকিরের গান শুনেছি, গেয়েছি, তাঁর গান মূলত তত্ত্বগান। রাধারমণের গানের সঙ্গে নিজের গানের মিল-অমিল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, রাধারমণের গানের সাথে আমার গানের বেশ মিল আছে। ছোট বেলা থেকে তার গান শুনে আসছি। তাঁর অনেক তত্ত্ব গান আছে, যা হিন্দু মুসলমান সবাই পছন্দ করে। তবে, খুব গভীর তত্ত্ব নাই। তাঁর গানের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের ভাবধারার গান বেশি। আর আমি দেহতত্ত্বকে বেশি ভালোবেসেছি। দেহের মাঝেই সবকিছু আছে।
শাহ আবদুল করিম একই সঙ্গে ভক্তিবাদী এবং যুক্তবাদী। ভক্তিকে তিনি যুক্তির নিরিখে বিচার করে নিতেই পছন্দ করতেন। তাঁর সাহসী উচ্চারণ তাই গান হয়ে উঠেছিল-
‘দেখাও দাও না কথা কও না
আর কত থাকি দূরে।
মুর্শিদ শোনো হে কেমনে চিনি তোমারে।’
ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর সরল ও দৃঢ় যুক্তিবাদী উচ্চারণ ছিল-
‘শুনি উনি আছেন। দেখি নাই তো কোনোদিন…’।
যুক্তিবাদী বিবেচনার ভেতর দিয়ে তিনি প্রকৃতিবাদী এবং সর্বপ্রাণবাদীর মতো কথা বলতেন। শাহ আবদুল করিম বাংলার অন্যান্য সাধকদের থেকে ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। তিনি সাধনসঙ্গীতের পাশাপাশি রচনা করেছিলেন জনমানুষের অধিকার আদায়ের গান ‘গণসঙ্গীত।’ শাহ আবদুল করিমের গণচেতনা বাংলাদেশের শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাদৃত ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন নিয়ে শাহ আবদুল করিমের গান আছে। এদেশের বাউল সাধকদের মধ্যে শাহ আবদুল করিম যে গণচেতনা প্রকাশ করেছেন তা সত্যি অন্যরকম একটা ঘটনা। এছাড়া, তাঁর প্রেমের গানগুলোও অকৃত্রিম। তা শহুরের আধুনিক শিল্পীদের অবলম্বন বা ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে দেখে আনন্দই লাগে।’
ব্যক্তিজীবনে শাহ আবদুল করিম ছিলেন সহজ সরল ও সাদা মাটা। কিন্তু তার সহজ সরলতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক। তাইতো তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়- মানবদেহের হাত ও পায়ের বিশ আঙ্গুলের কথা তিনি বলেছেন এভাবে-
‘আজব রঙের ফুল ফুটেছে
মানবগাছে
চার ডালে তার বিশটি পাতা
কী সুন্দর আছে’।
দেহ তত্ত্ব নিয়ে বাউল সম্রাটের ভাবনা ছিল অতি সুক্ষ্ম। তিনি বলেন-
‘গাড়ি চলে না, চলে না
চলে না রে
গাড়ি চলে না’।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ
আনন্দবাজার/শহক