প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের সরকারি সফরে ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর সফর ঘিরে ইতোমধ্যে কূটনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। তারই অংশ হিসেবে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক অর্থনীতি, বাণিজ্য নিয়ে দৈনিক আনন্দবাজারকে লিখিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক আহমাদ আরিফ।
- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কোন কোনখাতে অগ্রগতি অর্জন করবে?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শীর্ষ বৈঠকের পর প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে দু’দেশের সম্পর্ক আরও গভীর ও ফলপ্রসূ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই নেতার বৈঠক শেষে তাঁদের উপস্থিতিতে দু’দেশের কর্মকর্তারা সাতটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। বহুকাঙ্ক্সিত তিস্তারপানি চুক্তির বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে গতানুগতিক আশাবাদ ছাড়া কিছু পাওয়া না গেলেও ভারত থেকে জ্বালানি তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে তা কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হবে, তা ঠিক হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সফর বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে ভারতের কিছু বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- বাংলাদেশ-ভারত আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য কমিয়ে আনা যায় কীভাবে? ভারতে এক হাজার পণ্য রপ্তানির সুযোগ দিলেও বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে দুই আড়াইশ। এর কারণ কী?
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের ঘরে পৌঁছে। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫৫.৬২ শতাংশ বেশি। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানি বেড়েছে ২০.৫৩ শতাংশ। বছর শেষে ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির আশা রয়েছে। অন্যদিকে এপ্রিল-অক্টোবর ২০২১ সময়কালে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি টাকার অঙ্কে গত অর্থবছরের (২০২০-২১) একই সময়ের তুলনায় ৮১ শতাংশ বেড়েছে, যার পরিমাণ প্রায় পৌনে আটশো কোটি (৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ডলার।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ভারতের স্পর্শকাতর পণ্যতালিকা ৪৮০টি থেকে কমিয়ে মাত্র ২৫টিতে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এর ফলে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে প্রায় শতভাগ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা প্রদান করা হয়। এই হিসাবে প্রতিবেশী হওয়ায় বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতে কম খরচে বেশি পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা। কিন্তু বাড়েনি, বরং বাণিজ্য ঘাটতি দিন দিন বেড়েছে। অথচ ভারতে বিশাল ও বিকাশমান বাজার রয়েছে। বৈশ্বিক বাজার থেকে ভারতের আমদানির মোট মূল্যমান প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ভারতে বাংলাদেশ রপ্তানি করে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, কাঁচা পাট, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য ও বাইসাইকেল। তবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, এসব পণ্য ভারত নিজেই উৎপাদন করে এবং অন্য দেশে রপ্তানি করে। এই অভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বা সমজাতীয় পণ্যের রপ্তানির কারণে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা খুব কম। আর বাংলাদেশ সেখানে কম মূল্যে বিক্রি করতে পারে না।
- অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব তথা কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-সিইপিএ চুক্তি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এটি দু’দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-সিইপিএ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে পরিবহন, বিমা, ব্যাংকিং সেবা, টেলিযোগাযোগ ও বিতরণসহ বিভিন্ন বাণিজ্য সহায়ক সেবার প্রয়োজন তৈরি হবে। এই চুক্তির আওতায় যেসব খাতে বাংলাদেশ ভারতে বেশি সেবা রপ্তানি করতে পারবে, তার মধ্যে রয়েছে-পেশাদারি সেবা, আইটি/টিইএস সার্ভিস, অবকাঠামো ও এ-সংশ্লিষ্ট সেবা, আর্থিক এবং যোগাযোগ সেবা। আর ভারত যেসব খাতে বাংলাদেশে বেশি রপ্তানি করতে পারবে-অন্যান্য ব্যবসায়িক সেবা, পর্যটন, ব্যক্তিগত ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার, তথ্য-শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড-আইএমএফ বলেছে, প্রাথমিক হিসাবে সেপা বাস্তাবায়িত হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে ১৮০ শতাংশ এবং অশুল্ক বাধা ও এন্টি ডাম্পিং না হলে তা ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বাড়বে ১৯০ শতাংশ। এতে বাংলাদেশ ও ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে যথাক্রমে ১ দশমিক ৭২ এবং শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাণিজ্য সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো গেলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সীমা ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে।
- ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম অর্থনৈতিক দেশ। তার নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ কী ধরনের বাজার তৈরি ও ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সক্ষম?
প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশের তালিকায় ভারত জায়গা করে নেবে শীর্ষ তিনে। আর ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৮তম। আর ২০৫০ সালে ভারত হবে ২য় এবং বাংলাদেশ হবে ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
বাংলাদেশের এখন ভারতে রপ্তানি বাড়লেও সেটা কিন্তু ভারতের দেড়শ কোটি লোকের বিশাল বাজারের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। এ অবস্থার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। প্রবল জাতীয়তাবাদের কারণে আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা বাংলাদেশি পণ্য এড়িয়ে চলেন। কিন্তু চাকচিক্য ও ব্যয় মূল্যের কারণে তারা ঠিকই অন্য দেশের পণ্য কেনে। তাছাড়া ভারত সরকার সে দেশের পরিস্থিতি ও প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং প্রাধান্য দেয় সেখানকার ব্যবসায়ীদের দাবিকে। ফলে স্থানীয় শিল্প-ব্যবসাকে সুরক্ষা দিতে কখনো বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি (সিভিডি) আরোপ করে, আবার কখনো বিশেষ কোনো পণ্যে আ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি বসায়। এ অবস্থায়ভারতে রপ্তানি বাড়াতে হলে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি রপ্তানিকারকদেরও নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে ভারতের বাজার দখলের চেষ্টা করতে হবে। তাছাড়া বিশাল ব্যবধানের সমস্যা ক্রমবর্ধমানই থাকবে। বিদ্যমান অসংগতি দূর করতে কতটা দক্ষ, তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের প্রকৃত অর্জন। চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ের লোকজনের দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেম ঘাটতি নিয়ে সাধারণ্যে যে ধারণা রয়েছে, সেগুলো দূর করতেও পদক্ষেপ নিতে হবে।
- ভারত বাংলাদেশের রেলপথসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করছে তবে অর্থছাড়ে খুবই ধীরগতি। এ সফরে প্রধানমন্ত্রীকে সে বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ চাওয়া প্রয়োজন?
এক যুগেও হলেও ভারতের ঋণে খুলনা-মোংলা ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়নি। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প অনুমোদনের সময় নির্মাণকাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। ১২ বছরেও কাজ তো শেষ হয়ইনি, উল্টো ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অনুমোদনের সময় ৫ বছরে খুলনা-দর্শনা এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ নির্মাণ পরিকল্পনা ছিল। এসব কাজ ৪ বছর ৮ মাসেও শুরু হয়নি। বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজের দেখভালে ৪ বছরের চুক্তিতে ২৫ আগস্ট পরামর্শক নিয়োগ চুক্তি হয়েছে। এ দুই প্রকল্পে পৌনে ৫ বছরে এক টাকাও ঋণ দেয়নি ভারত। এ ছাড়া ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) এবং অনুদানে চলমান রেলের সাত প্রকল্পের ঋণ ছাড়ে গড়িমসি, নানা শর্ত, প্রতিটি ধাপ অনুমোদনে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের জটিলতা সৃষ্টি, ভারতীয় ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ এবং নির্মাণসামগ্রী কেনার বাধ্যবাধকতায়ও কাজের গতিতে ছেদ ফেলছে।
বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রীভারতের ঋণছাড়ে গড়িমসির পেছনে ভারত ও বাংলাদেশের আমলাদের দায়ী করেছেন। দুই দেশই পরস্পরকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বাংলাদেশের এ বিষয়ে কড়া মনোভাব প্রকাশ করা উচিত এবং ভারতকে এই বার্তা দেওয়া উচিত যে, প্রয়োজনে ঋণ চুক্তি বাতিল করে চীনসহ অন্য কোনো দেশের সহায়তা নেওয়া হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ঋণচুক্তির ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে ভারতকে জানানো উচিত।
আনন্দবাজার/শহক